ইতিহাসের বাঁক ছুঁয়ে তৌফিক-ই-ইলাহীর ‘জীবন রথ’

বাংলাদেশের ইতিহাসের নানা বাঁক বদলের কথা দুই মলাটে তুলে আনা ‘চ্যারিয়ট অব লাইফ’-এর প্রকাশনা উৎসবে এর লেখক প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেছেন, প্রকৃতপক্ষে এ বই হল তার ‘মনের কথা’।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 March 2018, 02:17 PM
Updated : 16 March 2018, 11:59 PM

মুক্তিযোদ্ধা সাবেক এই আমলা তার আত্মজীবনীমূলক এই গ্রন্থে নিজের জীবনের বিভিন্ন কালপর্বের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেছেন ‘তরুণ প্রজন্মের জন্য’। স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তাল দিনগুলোর পাশাপাশি হালের জরুরি আমলের ঘটনাপ্রবাহ সেখানে গুরুত্ব পেয়েছে।

শুক্রবার বিকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এই প্রকাশনা উৎসবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতসহ অতিথিরা বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন।

বইয়ের আলোচনায় প্রধান অতিথি মুহিত বলেন, “শেষ পর্যন্ত আমার মন্তব্য হচ্ছে, ইট ইজ অলমোস্ট পোয়েট্রি। এত সুন্দরভাবে লিখেছেন। ইটস পোয়েট্রি। এত সুন্দর! পড়ার উপযুক্ত এবং উপস্থাপনার ধরণটাও চমৎকার।”

 

দুটি ঘটনার উপর পুরো বই লেখা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “একটি হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধ, এপ্রিল মাস, ৭১ সাল। আর আরেকটি হচ্ছে, ২০০৮ সালে তার জেল যাত্রা। এই দুটি একটার পর আরেকটা এত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, এটাকে অ্যাপ্রিশিয়েট না করে উপায় থাকতে পারে না। স্টাইল অব প্রেজেন্টেশন ইজ বিউটিফুল।”

ইংরেজিতে লেখা বইয়ের বিষয়ে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র মুহিতের মূল্যায়ন: “আই মাস্ট অলসো মেক এ কমেন্ট অন আদার থিং। এটা একটা ইংরেজি বই। ইটস এ পিস অব গুড লিটারেচার। ভেরি গুড পিস অব লিটারেচার।”

সাত দশক পার করা জীবনে সময়ের ছুটে চলাই কেবল দেখেননি তৌফিক-ই-ইলাহী, ছুটেছেন তিনি নিজেও। সাক্ষী হয়েছেন, অংশ হয়েছেন ঐতিহাসিক নানা মুহূর্তের। আর সে সবের নানা ক্ষণ তুলে এনেছেন বইয়ে।

নিজের প্রথম একক বই ‘চ্যারিয়ট অব লাইফ: লিবারেশন ওয়ার, পলিটিকস অ্যান্ড সোজার্ন ইন জেল’ নিয়ে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, “বইটিতে আমি মনের কথা লেখার চেষ্টা করেছি। ভাবনার মধ্যে যা এসেছে সেটা গুছিয়ে বলার চেষ্টা করেছি। আমাদের জীবনতো শেষবেলায়... তরুণ প্রজন্মের কথা চিন্তা করে এগুলো লিপিবদ্ধ করেছি।”

তৌফিক-ই-ইলাহী জন্মেছেন ব্রিটিশ ভারতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার ক্ষত তখনও তরতাজা। সিলেটে তার জন্মস্থানের কয়েকশ’ কিলোমিটার দূরে ভারত-বার্মা সীমান্তে নাগাল্যান্ডের কোহিমায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভয়ঙ্কর বোমা হামলা করেছিল জাপান।

বই পড়ে মুগ্ধ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ইট ইজ অলমোস্ট পোয়েট্রি।

তার জন্মের সময়গুলোও ঘটনাবহুল। জন্মের পরপরই বিদায় নেয় ব্রিটিশরা, ভাগ হয়ে যায় ভারত। তিনি বড় হন পূর্ব পাকিস্তানে। পড়াশোনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরে ডক্টরেট করেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরুর কিছুদিন পর যোগ দেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তিনি চাকরি রেখে যোগ দেন যুদ্ধে। ৮ নম্বর সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার হিসেবে তিনি কমিশনপ্রাপ্ত হন। পরে তিনি বীরত্বের জন্য বীর বিক্রম উপাধি লাভ করেন। সচিব হিসেবে কাজ করার পর ২০০২ সালে অবসরে যান। ২০০৯ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা পদে নিযুক্ত হন।

আত্মজীবনীর বাইরে এই বই ইতিহাসের দলিলও। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে পাওয়া যাবে সেই সব ঘটনা, যা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের দিকে নিয়ে গিয়েছিল। কীভাবে বিশ্বকে জানানো হয়েছিল একটি স্বাধীন জাতির প্রতীক্ষিত জন্মের খবর।

এ সব ঘটনার তিনি কেবল প্রত্যক্ষদর্শীই ছিলেন না, সংগঠক হিসেবে অবদান রেখেছেন নানা পর্যায়ে। স্বাধীনতা যুদ্ধ, বাঙালি জাতির নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ এবং রক্তস্নাত ইতিহাসের উত্তাল সেই সময়ের বাইরেও ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা দিয়ে ক্ষমতায় আসা সরকারের সময়ের দিকেও।

প্রকাশনা উৎসবে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর একাত্তরের সহযোদ্ধারা।

ভাসমান বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন সংক্রান্ত দুর্নীতির মামলায় ওই সময় তাকে কারাগারে যেতে হয়েছে। বইয়ে ওই সময়কার ঘটনাপ্রবাহের নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে।

তার বর্ণনায় উঠে এসেছে, সে সময়কার সরকার নিজেদের মতো করে কথা বলিয়ে তাকে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। সেটা অস্বীকার করায় তাকেও মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়।

শুক্রবারের প্রকাশনা উৎসবে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, কবি হায়াৎ সাইফ, অধ্যাপক আরিফা রহমান, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী, সাংবাদিক সৈয়দ বদরুল আহসান, একাত্তর টিভির বার্তা পরিচালক  সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বইয়ের উপর আলোচনা করেন।

প্রকাশনা উৎসবের পাশেই স্টল থেকে ‘চ্যারিয়ট অব লাইফ: লিবারেশন ওয়ার, পলিটিক্স অ্যান্ড সোজার্ন ইন জেল’ কিনে নেন অনেকে।

বইটির প্রকাশনা উৎসব শুক্রবার অনুষ্ঠিত হলেও এর আগে গত ৮ ফেব্রুয়ারি বইটির মোড়ক উন্মোচন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শ্রাবণ প্রকাশনী থেকে বের হওয়া ৩৮৮ পৃষ্ঠার এই বইয়ের দাম ধরা হয়েছে ১২০০ টাকা।

শুভানুধ্যায়ী ও বিভিন্ন বয়সী মানুষের উপস্থিতিতে দর্শকপূর্ণ মিলনায়তনে তৌফিক-ই-ইলাহীর একাত্তরের কয়েকজন সহযোদ্ধাও ছিলেন।