বিমান দুর্ঘটনার ক্ষত নিয়ে ফিরলেন স্বজনহারা তিনজন

কাঠমান্ডুতে বিমান দুর্ঘটনার ক্ষত আর স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে নেপালে থেকে দেশে ফিরেছেন আরও তিনজন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 March 2018, 10:41 AM
Updated : 16 March 2018, 03:42 PM

গাজীপুরের ব্যবসায়ী মেহেদী হাসান, তার স্ত্রী সাঈদা কামরুন্নাহার স্বর্ণা এবং মেহেদীর ফুপাত ভাইয়ের স্ত্রী আলমুন নাহার অ্যানি শুক্রবার বিকালে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে ঢাকা পৌঁছান।

কিন্তু অ্যানির স্বামী ফারুক হোসেন প্রিয়ক এবং তাদের শিশু সন্তান প্রিয়ন্ময়ী তামারার আর কখনো ফেরা হবে না। গত ১২ মার্চের ওই দুর্ঘটনায় যে ৪৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, প্রিয়ক আর তামারাও রয়েছে তাদের মধ্যে। অবশ্য অ্যানিকে এখনও তা জানানো হয়নি।

ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর মেহেদী, স্বর্ণা আর অ্যানিকে অ্যাম্বুলেন্সে করে সরাসরি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আগের দিন দেশে ফেরা শেহরিন আহমেদও ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে ভর্তি আছেন। 

নেপালে বেঁচে যাওয়া দশ বাংলাদেশির মধ্যে শেখ রাশেদ রুবাইয়াত, কবির হোসেন ও মো. শাহীন বেপারিও রোববার দেশে ফিরবেন বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক এএইচএম এনায়েত হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন।

ব্যবসায়ী মেহেদী আর আলোকচিত্রী প্রিয়ক সম্পর্কে মামাতো-ফুপাতো ভাই। তাদের বাড়ি গাজীপুরের শ্রীপুরের নগর হাওলা গ্রামে।

দুই পরিবারের পাঁচজন মিলে গত ১২ মার্চ ইউএস-বাংলার ফ্লাইট বিএস২১১ তে নেপাল যাচ্ছিলেন। কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে অবতরণের সময় উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হলে ৪৯ জনের মৃত্যু হয়। তাদের মধ্যে চার ক্রুসহ ২৬ জন বাংলাদেশি।

দুর্ঘটনার পর উড়োজাহাজটিতে আগুন ধরে যাওয়ায় অধিকাংশ মরদেহ পুড়ে বিকৃত হয়ে গেছে। নেপালের মর্গে প্রিয়ক বা তার মেয়ের লাশ দেখার সুযোগ হয়নি স্বজনদের। 

মেহেদীর বাবা তোফাজ্জেল হোসেন, যিনি আবার প্রিয়কের মামা, শুক্রবার বিকালে কথা বলেন সাংবাদিকদের সঙ্গে। 

তিনি বলেন, “দুর্ঘটনার দিন সন্ধ্যা ৭টায় মেহেদীই নেপাল থেকে ফোন করে খবরটা দেয়। ওরা বেঁচে গেছে। কিন্তু প্রিয়কের মা এখন পাগল প্রায়।”

আলমুন নাহার অ্যানি

সাঈদা কামরুন্নাহার স্বর্ণা

মেহেদী হাসান

হাসপাতালে থাকতে হবে ৬ সপ্তাহ

দুর্ঘটনার ক্ষত নিয়ে দেশে ফেরা অ্যানি, মেহেদী আর স্বর্ণাকে আরও ছয় সপ্তাহ হাসপাতালে থাকতে হতে পারে বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা।

তাদের তিনজনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন এক সংবাদ সম্মেলনে তাদের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে কথা বলেন।

তিনি বলেন, মেহেদীর ঘাড়ের কশেরুকায় ফ্র্যাকচার হয়েছে। আর অ্যানির ফ্র্যাকচার ডান পায়ে। স্বর্ণার কোমরের বাঁ দিকে ব্যথা আছে, সেটা এক্সরে করে দেখতে হবে। তবে কারও বড় ধরনের ‘বার্ন ইনজুরি’ নেই।

“তারপরও তাদের শঙ্কামুক্ত বলা যাবে না। কারণ শ্বাসতন্ত্রের ইনজুরি রয়েছে। এ ধরনের রোগীদের কোনোভাবেই শঙ্কামুক্ত বলা যায় না। তবে জেনারেলি তাদের অবস্থা স্টেবল বলা যায়।”

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক এএইচএম এনায়েত হোসেন জানান, আহত এই তিনজনকে আরও অন্তত ছয় সপ্তাহ হাসপাতালে থাকতে হবে।

নেপাল বিমান দুর্ঘটনায় আহত সবার চিকিৎসার জন্য একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করার কথা জানিয়ে সামন্ত লাল বলেন, এই বোর্ড রোববার দেখে সিদ্ধান্ত জানাবে। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুপুরে ফোন করে আহতদের চিকিৎসার সর্বোচ্চ ব্যবস্থা করারও নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান তিনি।

কাঠমান্ডু থেকে দেশের পথে রওনা হওয়ার আগে অ্যানি, মেহেদী ও স্বর্ণা

‘আমার মেয়েটা কই?’

বিমান দুর্ঘটনার পর অ্যানি, মেহেদী আর স্বর্ণাকে ভর্তি করা হয় কাঠমান্ডু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পরদিনই সেখানে পৌঁছান মেহেদীর আত্মীয় ও বন্ধুরা। প্রিয়ক আর তামারার মৃত্যুর কথা তারা অ্যানিকে এখনও বলেননি। 

প্রিয়কের বন্ধু জাহাঙ্গীর আলম রিজভী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,“আজ  কাঠমান্ডু মেডিকেল কলেজ থেকে বের হওয়ার পর জানতে চেয়েছিল- তারা কোথায়। ওকে (অ্যানি) বলা হয়েছে, উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রিয়ক আর তামারাকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হচ্ছে।”

ঢাকা মেডিকেলে প্রিয়কের আরেক বন্ধু ইজাজ আহমেদ মিলন সাংবাদিকদের বলেন, অ্যানি কিছুক্ষণ পর পরই মেয়েকে দেখতে চাইছেন।

“আমরা বলেছি, তাদের অবস্থা আরও খারাপ, সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়েছে। তুমি দেশে ফিরে চল, সেখানে চিকিৎসার পর প্রয়োজনে তোমাকেও সিঙ্গাপুরে পাঠানো হবে। তবে অ্যানি মেয়ের জন্য খুবই বিচলিত।”

বিমানমন্ত্রী একেএম শাহজাহান কামাল ওই তিনজনকে দেখতে হাসপাতালে গেলে তার কাছেও মেয়ের খোঁজ জানতে চান অ্যানি।

তিনি বলছিলেন, “আমার মেয়েটা কিন্তু ছোট, একা খেতে পারে না্ ওদের অবস্থা কি বেশি খারাপ? কখন সিঙ্গাপুরে পাঠাবেন আপনারা?”

সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টায় বিমানমন্ত্রী তাকে দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করেন; বলেন, সব ঠিকঠাক খেয়াল রাখা হবে।

মেহেদী হাসান, সাঈদা কামরুন্নাহার স্বর্ণা ও আলমুন নাহার অ্যানির এই ছবি নেপালের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার আগে ঢাকা বিমানবন্দরে তোলেন অ্যানির স্বামী ফারুক হোসেন প্রিয়ক। আলোকচিত্রী প্রিয়ক ও তার শিশু সন্তান প্রিয়ন্ময়ী তামারা এখন না ফেরার দেশে

স্বজনের লাশের অপেক্ষা

মেহেদীর চাচাতো ভাই মাহবুব আলম ঢাকা মেডিকেলে সাংবাদিকদের বলেন, তারা প্রিয়ক আর তার মেয়ের লাশ দেখতে কাঠমান্ডুর মর্গে গেলেও তাদের অনুমতি দেওয়া হয়নি।

“আমরা বলেছিলাম, যাত্রীদের মধ্যে বাচ্চা আছে মাত্র দুটো, একটা ছেলে একটা মেয়ে। আমরা তো আমাদের মেয়েটাকে চিনতে পারতাম। কিন্তু তারপরও তারা দেখতে দেয়নি।”

পাঁচ দিন কাঠমান্ডু মেডিকেলে চিকিৎসার পর অ্যানি, স্বর্ণা আর মেহেদী বাংলাদেশে বিমানের একটি ফ্লাইটে যখন ঢাকায় পেঁছালেন, তাদের দেখতে বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “নিহতদের স্বজনদের এখন কেবল একটিই চাওয়া, কবে লাশ দেশে আসবে।”

এক প্রশ্নের জবাবে কাদের বলেন, “ইউএস বাংলা বলেছে, চিকিৎসার সকল খরচ তারা বহন করবে। তবে এর বাইরে যদি কাওকে সহায়তা দিতে হয়, আমাদের প্রধানমন্ত্রী দেবেন।”

পরে বিমানমন্ত্রী শাহজাহান কামাল ঢাকা মেডিকেলে সাংবাদিকদের বলেন, যেহেতু নিহতদের অধিকাংশের শরীর পুড়ে গেছে এবং শনাক্ত করা যাচ্ছে না, তাই ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করতে কিছুটা সময় লাগছে।

“আমি নেপালে গিয়ে সেখানে নিহত ২৬ জনের মধ্যে আট জনের লাশ দেখেছি, যাদের শনাক্ত করার উপায় আছে। বাকি ১৮ জনকে দেখতে পারিনি, পুড়ে যাওয়ায় তাদের চেনা যাচ্ছিল না।”

নেপালে বাংলাদেশ দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি অসিত বরণ সরকার সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, নিহত ৪৯ জনের ময়নাতদন্ত শুক্রবার শেষ করেছেন চিকিৎসকরা।  শনিবার লাশ শনাক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হবে।

“স্বজনরা ইতোমধ্যে নিহতদের চিহ্নত করতে সহায়ক বিভিন্ন তথ্য আমাদেরকে দিচ্ছেন। শারীরিক বর্ণনা, পোশাকের বর্ণনা, দৃশ্যমান শনাক্তকরণ চিহ্নগুলো তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। আমরা আশা করছি, অধিকাংশকে সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব হবে। ১৫ থেকে ২০ শতাংশের ক্ষেত্রে হয়ত ডিএনএ টেস্টের প্রয়োজন হবে।”

সম্ভব হলে মঙ্গলবার থেকেই বাংলাদেশিদের মরদেহ দেশে পাঠানোর চেষ্টা করা হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

বেঁচে যাওয়া দশ বাংলাদেশির মধ্যে কাঠমান্ডুর ওম হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া রিজওয়ানুল হককে বুধবার সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। কাঠমান্ড মেডিকেল থেকে শাহরিন আহমেদকে বৃহস্পতিবার বিকালে দেশে ফিরিয়ে এনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক এএইচএম এনায়েত হোসেন জানিয়েছেন,কাঠমান্ডু মেডিকেলে থাকা শেখ রাশেদ রুবাইয়াত, কবির হোসেন এবং মো. শাহীন বেপারি রোববার দেশে ফিরবেন।

বাকি দুজনের মধ্যে ইয়াকুব আলী কাঠমান্ডুর নরভিক হাসপাতালে  এবং ইমরানা কবির হাসি কাঠমাণ্ডু মেডিকেলের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ জানান, ওই দুইজনের মধ্যে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হাসির অবস্থা এখনও ঝুঁকিপূর্ণ।

“স্বজনরা তাকে নেপালের বাইরে অন্য একটি দেশে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা করছেন।  কিন্তু তার সংজ্ঞা ফেরেনি, ডাক্তাররা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন।”