খালেদার জামিন স্থগিত, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বাহাস

জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে হাই কোর্টের দেওয়া জামিন আটকে গেছে আপিল বিভাগে। এনিয়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বাহাসে জড়িয়েছেন বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 March 2018, 03:34 AM
Updated : 14 March 2018, 03:52 PM

হাই কোর্টের দেওয়া চার মাসের জামিন আদেশ আগামী রোববার পর্যন্ত স্থগিত করে ওই সময়ের মধ্যে দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষকে নিয়মিত আপিলের আবেদন  (লিভ টু আপিল) করতে বলেছে সর্বোচ্চ আদালত।

দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বিভাগ বুধবার এ আদেশ দেয়।

জামিন স্থগিতের এই আদেশে ক্ষোভ জানিয়ে বিএনপির আইনজীবী বলেছেন, এর মধ্য দিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হল।

এদিকে নাশকতার একটি মামলায় খালেদাকে গ্রেপ্তার দেখানোর বিরুদ্ধে কুমিল্লার আদালতে গিয়েও ফল পাননি তার আইনজীবীরা। ফলে কারাবন্দি খালেদা জিয়াকে ওই মামলায়ও গ্রেপ্তার থাকছেন।

জিয়া এতিমখানা মামলায়  গত ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার জজ আদালত সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার পর থেকে তিনি পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন সড়কের পুরনো কারাগারে বন্দি।

পূর্ণাঙ্গ রায় পেতে দেরি নিয়ে নানা আলোচনার মধ্যে তা পাওয়ার পর হাই কোর্টে আপিল করে জামিন চেয়েছিলেন খালেদা। তাতে হাই কোর্ট চার মাসের জন্য জামিন দেয়।

ওই আদেশ স্থগিতে মামলাকারী দুর্নীতি দমন কমিশন ও রাষ্ট্রপক্ষ মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী তা শুনানির জন্য আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

বুধবার আবেদনটি আপিল বিভাগে উঠলে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খানের শুনানির মধ্যেই প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, “আগে সিপি (নিয়মিত লিভ টু আপিল দায়ের করেন) নিয়ে আসুন। এখনও তো সিপি আসেনি। তখন দেখব।”

“আপনারা কি আদেশের অনুলিপি পাননি’- প্রধান বিচারপতির এই প্রশ্নে খুরশীদ আলম বলেন, “সে জন্যেই তো স্টে চেয়েছি রোববার বা সোমবার পর্যন্ত। ৫টার সময় অফিস বন্ধ হয়ে যায়। তাই গতকাল আমরা আদেশের কপি পাইনি। আদেশের কপি পেলে লিভ টু আপিল করব।”

 তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, “সিপি করে আসুন। সে পর্যন্ত স্থগিত।”

এই পর্যায়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নাল আবেদীন উঠে দাঁড়ান।

জয়নাল আবেদীন বলেন, “আমাদের শুনবেন না? না শুনেই স্থগিতাদেশ দিলেন?”

প্রধান বিচারপতি তখন বলেন, “রোববার পর্যন্ত তো স্থগিত করা হয়েছে। ওই দিন শুনব।”

জয়নাল আবেদীন বলেন, “না শুনে আদেশ দেওয়া হল, আমাদেরও তো বক্তব্য আছে।”

প্রধান বিচারপতি বলেন, “কোর্টকে কোর্টের মতো কাজ করতে দিন।”

জয়নাল আবেদীন বলেন, “লিভ টু আপিল আসুক, কিন্তু আপনি হাই কোর্টের আদেশে স্থগিতাদেশ দিয়েন না। এভাবে স্থগিতাদেশ দেওয়া হলে কোর্ট সম্পর্কে পাবলিক পারসেপশন খারাপ হবে।”

তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, “পাবলিক পারসেপশন কী হচ্ছে, আদালত সেদিকে তাকায় না।”

খালেদা জিয়ার এ আইনজীবী তখন বলেন, “হাই কোর্টের আদেশ চেম্বার আদালত স্থগিত করেনি। আর আসামি তো বের হচ্ছে না। তাহলে স্টে কেন প্রয়োজন?”

এ জে মোহাম্মদ আলীও দাঁড়িয়ে বলেন, “আমরা তো শুনানির সুযোগ পেলাম না। এটা ন্যায়বিচারের পরিপন্থি।”

আদালত তাদের কথায় আর কান না দিয়ে দিনের কার্যতালিকা ধরে কাজ শুরু করলেও বিএনপির আইনজীবীরা আদালত কক্ষেই দাঁড়িয়ে থাকেন।

তা দেখে তাদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, “আপনারা দাঁড়িয়ে আছেন কেন? দাঁড়িয়ে থাকলে আদালতের ডেকোরাম নষ্ট হয়। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে কাজ করব কীভাবে?”

এসময় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সহ সভাপতি গিয়াস উদ্দিন আহমদ প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ করে বলেন, “আপনি তো না শুনেই একতরফা আদেশ দিলেন। আমাদের কথা শুনতে হবে। কেন শুনবেন না?”

প্রধান বিচারপতি তখন বলেন, “কার কথা শুনব আর কার কথা শুনব না, তা কি আপনার কাছ থেকে শুনতে হবে?”

গিয়াস উদ্দিন তখন উচ্চস্বরে বলেন, “আপনাকে শুনতে হবে।”

প্রধান বিচারপতি বলেন, “আপনি কি আদালতকে থ্রেট (হুমকি) দিচ্ছেন? বেশি বাড়াবাড়ি হচ্ছে।”

গিয়াস উদ্দিন বলেন, “শুনে তারপর আদেশ দিতে হবে।”

প্রধান বিচারপতি আবার বলেন, “থ্রেট দিবেন না।”

এ সময় আদালতে বিএনপির আইনজীবীরা উচ্চস্বরে বিভিন্ন মন্তব্য করতে থাকেন।

এরই মধ্যে অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ করে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক মাহবুবউদ্দিন খোকন বলেন, “আপনি তো কোর্টকে শেষ করে দিলেন।”

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। তখন একদল আইনজীবী ‘দালাল দালাল’ বলতে বলতে আদালত কক্ষ ছেড়ে আসেন।

পরে সুপ্রিম কোর্টে বিক্ষোভ মিছিল করে বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা। তারা প্রধান বিচারপতির পদত্যাগও দাবি করেন।

বিএনপি বরাবরই বলে আসছে, আগামী নির্বাচনে খালেদা জিয়ার অংশগ্রহণের পথ আটকাতে ‘সাজানো মামলায় গায়ের জোরে’ সাজা দেওয়া হয়েছে তাদের নেত্রীকে।

বিচার বিভাগের উপর আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃত্ব খাটাচ্ছে বলেও তাদের অভিযোগ। তবে সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা সেই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আসছেন। 

খালেদার কৌঁসুলিদের প্রতিক্রিয়া

আদালত থেকে বেরিয়ে জয়নাল আবেদীন সাংবাদিকদের বলেন, “আমাদের কোনো বক্তব্য তিনি (প্রধান বিচারপতি) শুনলেন না। কোনো রকম আইনগতভাবে এই মামলাটি মোকাবেলা করার জন্য ন্যূনতম সুযোগ আমাদের দিলেন না। না দিয়ে স্টে অর্ডার পাস করলেন।

“আমরা প্রধান বিচারপতিকে বলেছি যে, মাননীয় আদালত আমাদের কথা না শুনে কোনো অর্ডার পাস ইতোপূর্বে আমরা কখনও দেখিনি। এতে করে পাবলিক পারসেপশন খারাপ হবে। তিনি আমাদের কথা শুনলেন না। না শুনে বললেন, আগামী রোববার পর্যন্ত স্টে থাকবে। আগামী রোববার সিপি ফাইল করা হবে।”

বিএনপির সংবাদ সম্মেলনে তাদের আইনজীবী নেতারা

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নাল বলেন, এই আদেশে তারা ‘অত্যন্ত ব্যথিত’ হয়েছেন।

“বিচার বিভাগ ইতোপূর্বে এইরকম কখনও ছিল না। আজকের বিচার বিভাগের কাছ থেকে এটা আশা করি নাই।… এই আদেশের বিষয়ে কী ভাষায় আপনাদের কাছে বর্ণনা করব তা বুঝতে পারছি না।”

রোববার আদালত উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে বুধবারের আদেশটি বাতিল করবেন এবং জামিনে মুক্তি পেয়ে খালেদা জিয়া আবার জনসম্মুখে আসবেন বলে আশা প্রকাশ করেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান জয়নাল।

পরে খালেদার আইনজীবীরা নয়া পল্টনে বিএনপি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনেও আসেন।

সেখানে সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ বলেন, “উচ্চতম আদালত যে কোনো আদেশ দিতে পারেন, কিন্তু এক পক্ষের বক্তব্য শুনে এই ধরনের আদেশ দেওয়া মোটেই যুক্তিসঙ্গত নয়। এতে দেশের উচ্চতম আদালতের ঐতিহ্য এবং ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে আমরা মনে করি।”

দুদকের কৌঁসুলি খুশি

মামলাকারী দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম সাংবাদিকদের বলেন, বুধবার না পারলেও বৃহস্পতিবার দুপুরের মধ্যে আপিলের আবেদন করবেন তারা।

কী কারণে জামিন স্থগিত হয়েছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “স্থগিতের কখনও রিজন দেওয়া হয় না। চেম্বার জজ বলেন, আর ফুল কোর্ট বলেন, যখন স্টে দেওয়া হয়, তখন কোনো রিজন দেওয়া হয় না। আদালতের এ আদেশে আমি হ্যাপি।”

খুরশীদ আলম বলেন, “আদালতে বলেছি, উনার (খালেদা জিয়ার) পাঁচ বছরের সাজা হয়েছিল। হাই কোর্ট ডিভিশন চারটি গ্রাউন্ডে উনাকে জামিন দিয়েছেন। আমি আপিল বিভাগে নজির দেখিয়েছি। আপিল বিভাগের জাজমেন্ট এখনও রিভার্স হয়নি। রিভার্স যদি না হয়ে থাকে ইট ইজ বাইন্ডিং আপ দ্য হাই কোর্ট ডিভিশন। কিন্তু হাই কোর্ট ডিভিশন এ ব্যাপারে কিছুই বলেনি। কাজেই আমি মনে করি এ মেটারগুলো এক্সামিন করা উচিৎ।”

হাই কোর্ট চারটি যুক্তিতে খালেদার জামিন আবেদন মঞ্জুর করেছিল।

এগুলো হল- ১. নিম্ন আদালত পাঁচ বছরের সাজা দিয়েছে, এই সাজায় হাই কোর্টে জামিনের রেওয়াজ আছে। সে বিবেচনায় তিনি জামিন পেতে পারেন। ২.  বিচারিক আদালতের নথি এসেছে, কিন্তু আপিল শুনানির জন্য এখনও প্রস্তুত হয়নি। ফলে আসামি জামিনের সুবিধা পেতে পারেন। ৩. বিচারিক আদালতে মামলা চলাকালে খালেদা জিয়া জামিনে ছিলেন; এর অপব্যবহার করেননি। আদালতে নিয়মিত উপস্থিত ছিলেন। ৪. বয়স এবং বয়সজনিত শারীরিক অসুস্থতা বিবেচনায় নিয়ে তাকে জামিন দেওয়া যায়।

বিএনপি আইনজীবীরা শুনানির সুযোগ না পাওয়ার যে কথা বলছেন, তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে দুদকের কৌঁসুলি খুরশীদ বলেন, “সেটা আমি জানি না। সেটা উনাদের অ্যালিগেশন। পলিটিক্যাল কোনো প্রশ্ন আমাকে করা ঠিক হবে না।”

অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য

আপিল বিভাগের আদেশের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তার কার্যালয়ে শুনানির বিষয়বস্তু সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেন।

মাহবুবে আলম। ফাইল ছবি

তিনি বলেন, “আমাদের বক্তব্যের মাঝে দাঁড়িয়ে বিএনপিপন্থি আইনজীবী বিশেষ করে বারের সভাপতি আদালতকে দেখালেন যে হাই কোর্টের আদেশটি ইতোমধ্যে টাইপ হয়ে গেছে এবং বিচারপতিবৃন্দ অলরেডি সইও করে দিয়েছেন।

“সুপ্রিম কোর্টের নিয়ম হল, হাই কোর্টের আদেশটি সই হয়ে গেলে সার্টিফায়েড কপি দিয়ে যখন লিভ পিটিশন ফাইল করা হয়, আপিল বিভাগকে সেটাই শুনতে চায়। হাই কোর্টের আদেশ সঠিক হয়েছে কি না, এটা বিচারের জন্য উনারা (আপিল বিভাগের বিচারপতিরা) তখন লিভ পিটিশন ফাইল করতে বলেন।

“আজও তাই হয়েছে। যখনই অপরপক্ষ বলেছে যে, হাই কোর্ট আদেশে সই করেছেন, তখনই আপিল বিভাগ বলেছে রাষ্ট্রপক্ষ এবং দুদক লিভ টু আপিল ফাইল করুক। আগামী রোববার পিটিশনের শুনানি হবে। সে অবধি হাই কোর্টের আদেশের কার্যকারিতা স্থগিত থাকবে। এটাই আপিল বিভাগের সাধারণ নিয়ম।”

বিএনপির আইনজীবীদের অভিযোগের বিষয়ে মাহবুবে আলম বলেন, “যখনই তারা বলেছে যে, হাই কোর্টের আদেশটা অলরেডি সই হয়ে গেছে, তখন আপিল বিভাগ মূল পিটিশনটিই শুনতে চান। এটাই তো সবসময় নিয়ম। মূল আদেশটি ছাড়া উভয় পক্ষকে শুনলে তো কোনো লাভ হবে না। যে আদেশটি হয়ে গেছে সেটি পর্যালোচনা করাই হল আপিল বিভাগের কাজ।”

আদালতে বিএনপির আইনজীবীদের আচরণের সমালোচনা করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা হাই কোর্টেও উষ্মা প্রদর্শন করেছিলেন, কিন্তু হাই কোর্ট আদেশ দিয়েছে।”

মাহবুবে আলম সোমবার বলেছিলেন, আপিল বিভাগ যদি খালেদা জিয়াকে জামিনও দেয়, তারপরও তার মুক্তি মিলবে না, কারণ কুমিল্লার মামলায় তাকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

কুমিল্লার আদালত যে হাজিরা পরোয়ানা জারি হয়েছে, সে মামলাতেও খালেদা জিয়াকে জামিন নিতে হবে।

মাহবুবে আলমের ভাষ্য, “কাস্টডি ওয়ারেন্ট দেওয়ার অর্থই হল সে মামলাতেও তিনি এখন অবরুদ্ধ। তিনি সেই মামলায় জেলে আছেন বলে ধরতে হবে। কাজেই ওই মামলাতে তাকে জামিন না নিয়ে মুক্তি পাওয়ার কোনো অবকাশ নেই।”

বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, তাদের নেত্রীকে কারাগারে আটকে রাখতে নানা ‘ছল-চাতুরি’ করছে সরকার।