সাহায্য হাতে হাতে চান পোড়া বস্তির বাসিন্দারা

পুড়ে যাওয়া ঘরেই সারা রাত কাটিয়েছেন নূর হোসেন।

কাজী নাফিয়া রহমান নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 March 2018, 07:21 PM
Updated : 13 March 2018, 07:21 PM

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চোখের সামনে ঘরবাড়ি, জিনিসপত্র সব শেষ। এখন কেমনে কী করব সেই চিন্তায় আছি। খাব কী আর থাকব কোথায়?”

ঢাকার মিরপুরের ১২ নম্বর সেকশনে ইলিয়াস মোল্লা বস্তিতে মঙ্গলবার গিয়ে পাওয়া যায় নুর হোসেনকে। আগের দিন অগ্নিকাণ্ডে এই বস্তির চার হাজারের মতো ঘর পুড়ে যায়, তার মধ্যে নুর হোসেনের ঘরও ছিল।

বস্তিতে ক্ষতিগ্রস্তদের দেখতে এসে মঙ্গলবার সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ১০০ টন চাল ও ১০ লাখ টাকা সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়ার আশ্বাস দেন।

নূর হোসেনের চাওয়া এই সহায়তা যেন তাদের হাতে দেওয়া হয়।

“ওনারা নিজেরা যদি দেয়, তাহলে আমরা পাব, খায়া বাঁচতে পারব। আর যদি কারও হাতে দেয়, তাহলে আমরা পাব না।”

বস্তির আরেক বাসিন্দা জাহান আরা বলেন, “মন্ত্রী এমপিরা আসে, মানুষ আসে আর ছবি তুলে চলে যায়। আমাদের তাতে কী হয়? সরকার টাকা দিলেই কি আমরা পাব?”

স্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের জন্যও তিনি সরকারের কাছে দাবি জানান।

“আমাদের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব তো আর সরকার পোষাতে পারবে না। খালি পুনর্বাসনটা করলে সেটা আমাদের জন্য যথেষ্ট।”

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাদের বলেন, বস্তিবাসীদের জন্য তাদের স্থায়ী আবাসন করতে সরকার বাউনিয়ায় বিরাট এলাকাজুড়ে পূনর্বাসনের জন্য ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে।

অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিতে দেখা যায়, পুড়ে যাওয়া ঘর পরিষ্কারে ব্যস্ত অনেকেই। কেউ কেউ আবার কাপড় বা টিন দিয়ে বসে আছেন পোড়া ঘরে। কেউ আবার পুড়ে যাওয়া জিনিপত্র চুরির আশঙ্কায় পাহারা দিচ্ছেন।

বস্তিবাসীদের অভিযোগ, ফায়ার সার্ভিসের গুরুত্ব দিয়ে আগুন নিভাতে আসেনি বলে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে।

বস্তির বাসিন্দা মো. সারোয়ারের এই কথায় সমর্থন দেন নূরুন্নাহার নামে আরেক বাসিন্দা।

গার্মেন্টেকর্মী নরুন্নাহার বলেন, “রাত ৩টা ১০ মিনিটে আগুন লাগে। আলিম নিটওয়্যার গার্মেন্টেস গিয়ে ৩টা ১৭ এর দিকে ফায়ার সার্ভিসকে ফোন করে জানানো হলেও তারা আসে ৪৫ থেকে ৫০ মিনিট পর।”

বস্তির ভেতরের গলি সরু হওয়ায় সহজে আগুন নেভানো যায়নি বলে স্বীকারও করেন তিনি।

আগুন লাগার কারণ জানতে চাইলে ষড়যন্ত্রের সন্দেহের কথা বলেন নুরুন্নাহার।

“বিচ্ছিন্নভাবে লাগলে বিভিন্ন ঘর পুড়ত না। আগুন লাগলে পাশের ঘরগুলায় লাগত। কিন্তু আলাদা আলাদাভাবে আগুন লাগল কেমনে?”

ফায়ার সার্ভিসের ২১টি ইউনিট সাড়ে তিন ঘণ্টার চেষ্টায় সকাল সাড়ে ৭টার দিকে এই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তার আগেই পুড়ে যায় ৪ হাজার ঘর।

বস্তিতে নিজের পোড়া ঘরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন গার্মেন্টসকর্মী স্মৃতি আক্তার রুবি।

তিনি বলেন, “মানুষের চিল্লাচিল্লিতে ঘুম থেকে উইঠাই দেখি কারেন্ট নাই। মাথার উপরে আগুন। কোনোমতে বাচ্চাদের নিয়ার বাইর হইছি।”

ঘরের সব আসবাবপত্রসহ টাকা-পয়সাও আগুনে পুড়ে গেছে বলে জানান তিনি।

বালিশের নিচে রাখা ৭ হাজার টাকা নিয়েও বের হতে পারেননি স্মৃতি।

তিনি বলেন, “সব পুইড়া গেছে। একটা গেলাস পর্যন্ত নাই একটু পানি খাওয়ার জন্য। এমনিতে চিপা রাস্তা। আবার কারেন্ট নাই। অন্ধকারে কিচ্ছু দেখতে পারি নাই যে, একটা জিনিস নিয়া বাইর হমু।”

নিজের কষ্টের জীবনের কথা তুলে ধরে স্মৃতি বলেন, “সুখ কি জিনিস, দেখি নাই। কষ্ট করতে করতে জীবন শেষ। বাপ-মার সংসারেও ছিল অভাব। অভাবের সংসারে ভাইবোন মানুষ করতে করতে বিয়ে হইছে। তারপর বিয়ে হইছে, সেখানেও অভাব। গার্মেন্টেসে চাকরি কইরা, ওভারটাইম কইরা অনেক কষ্টে কিছু টাকা জমায়া ঘরটা করছিলাম, জিনিসপত্র করছিলাম।”

“স্বামীও অসুস্থ। দুইটা ছেলেরে কেমনে মানুষ করমু,” বলেই কাঁদতে থাকেন তিনি।

পোড়া জিনিসপত্র হাতড়াতে হাতড়াতে শেফালি বেগম বলেন, “এই ঘরটাই ছিল আমার সব। কত কিছু করছিলাম ঘরটায়। ফ্রিজ, টিভ, খাট, টেবিল, কী আছিল না। সবকিছুই পুড়ে গেছে। এক বস্তা চাল পুড়ে গেছে। ছেলেমেয়েদের সব সার্টিফিকেট পুড়ে গেছে। বেতনের টাকা ছিল ঘরে। এখন সব শেষ।”

শেফালির মা, ভাই, বোন- সবাই থাকতেন এই বস্তিতে। সবার ঘরই পুড়ে গেছে আগুনে।

“কই আর যামু। এইখানেই ছিল সবাই। বাইরে কোনো একটা আত্মীয় থাকলে তার কাছে গিয়া থাকতাম। তাও তো নাই।”