যুদ্ধাপরাধ: নোয়াখালীর ৩ আসামির মৃত্যুদণ্ড

একাত্তরে নোয়াখালীর সুধারামে হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের মত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং একজনকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 March 2018, 05:57 AM
Updated : 13 March 2018, 02:51 PM

এদের মধ্যে আমির আলী, মো. জয়নাল আবদিন, ও আবুল কালাম ওরফে এ কে এম মনসুরের ফাঁসির রায় হয়েছে। আর মো. আব্দুল কুদ্দুসের হয়েছে ২০ বছরের কারাদণ্ড।

এই চার আসামির মধ্যে মনসুর পলাতক। বকি তিনজন রায়ের সময় কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন।

বিচারপতি শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মঙ্গলবার এ মামলার রায় ঘোষণা করে।

রায়ে বলা হয়, প্রসিকিউশনের আনা তিন অভিযোগের সবগুলোই প্রমাণিত হয়েছে। মৃত্যুদণ্ডের তিন আসামির সাজা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে কার্যকর করতে হবে।

সেই সঙ্গে পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তার করে সাজা কার্যকর করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের আইজিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে।

নিয়ম অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালের মামলায় রায়ের এক মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করা যায়। তবে পলাতক আসামিকে সে সুযোগ নিতে হলে আত্মসমর্পণ করতে হবে।

এই রায়ের সন্তোষ প্রকাশ করে মামলার প্রসিকিউটর জাহিদ ইমাম সাংবাদিকদের বলেন, “তিনটি অভিযোগই প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। সর্বোপরি এ রায়ে প্রসিকিউশন সন্তুষ্ট।”

অন্যদিকে আসামি জয়নাল আবদিনের আইনজীবী গাজী এম এইচ তামিম বলেন, “আমার মক্কেল এ রায়ে সংক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি মনে করছেন, এ রায়ে তিনি ন্যায়বিচার পাননি, কারণ ঘটনার ৪৫ বছর পরে সাক্ষীরা যে সাক্ষ্য দিয়েছে, তাতে একজনের সঙ্গে আরেকজনের সাক্ষ্যের অসঙ্গতি রয়েছে।”

এই আইনজীবী বলেন, এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে আসামিপক্ষ ন্যায়বিচার পাবে বলে দার বিশ্বাস।

তামিম এ মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি আবুল কালাম ওরফে এ কে এম মনসুরের পক্ষেও রাষ্ট্র নিয়োজিত আইনজীবী হিসেবে মামলা লড়েন।

তিনি বলে, “এ মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণে এত বেশি অসঙ্গতি যে আইন-আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে তিনি (মনসুর) যদি আদালতে আত্মসমর্পণ করে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন, তাহলে তিনিও ন্যায়বিচার পাবেন বলে আমি মনে করি।”

এ মামলায় প্রাথমিকভাবে পাঁচ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হলও মামলার অভিযোগ গঠনের আগে মো. ইউসুফ আলী নামে এক আসামি গ্রেপ্তারের পর অসুস্থ হয়ে মারা যান। পরে তার নাম মামলা থেকে বাদ দেওয়া হয়।

অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২০১৬ সালের ২০ জুন এ মামলার বিচার শুরু করে আদালত।

ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত রায় আসা ৩১টি মামলার ৭১ আসামির মধ্যে তিনজন বিচারাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। মোট ৬৮ জনের সাজা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৪১ যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ সাজার রায় এসেছে।   

পর্যবেক্ষণ

এ মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বলেছে, জেনে বুঝে যারা মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘৃণিত অপরাধে যারা যুক্ত হয়েছে, সেই দায় তারা কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।

“এ মামলার আসামিরা অংশগ্রহণমূলকভাবে অপরাধ সংঘঠন করেছে। অপরাধে তারা সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল। এমনকি তারা জেনেবুঝে মানবতাবিরোধী অপরাধের মত ঘৃণিত অপরাধ সংগঠনের উদ্দেশ্যে সম্পৃক্ত হয়েছিল।

“ফলে তারা অপরাধ সংঘটন করেছিল, নাকি করেনি- তা বড় কথা নয়।”

বিচারক বলেন, আসামিরা সচেতনভাবে অপরাধ সংগঠনের জন্য সমবেত হয়েছিল, যা ‘সম্মিলিতভাবে অপরাধ সংঘটনের’ মধ্যে পরে।

রায় ঘোষণার সময় প্রসিকিউটর জাহিদ ইমাম ছাড়াও ট্রাইব্যুনালে চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম, তুরিন আফরোজ, প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল, প্রসিকিউটর সবিনা ইয়াসমিন মুন্নি, তাপস কান্তি বল উপস্থিত ছিলেন।

আসামি পক্ষের আইনজীবী ছাড়াও গ্রেপ্তার তিন আসামির আত্মীয়রাও রায় ‍শুনতে আদালতে এসেছিলেন।

১৫৯ পৃষ্ঠার রায়

মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১০টায় আদালত বসার পর নোয়াখালীর চার আসামির রায়ের কার্যক্রম শুরু হয়। গ্রেপ্তার তিন আসামিকে তার আগেই কারাগার থেকে আদালতে নিয়ে আসা হয়।

শুরুতেই নেপালে বিমান দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় শোক প্রকাশ করে আদালত।

তিন সদস্যের এ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম প্রারম্ভিক বক্তব্যে জানান, এ মামলায় তারা যে রায় দিচ্ছেন, তা ১৫৯ পৃষ্ঠার।

পরে ট্রাইব্যুনালের বিচারক আবু আহমেদ জমাদার রায়ের সার সংক্ষেপের প্রথম অংশ পড়া শুরু করেন। বিচারপতি আমির হোসেন পড়েন রায়ের দ্বিতীয় অংশ। সবশেষে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান সাজা ঘোষণা করেন।

প্রসিকিউশনের পক্ষে এ মামলায় শুনানি করেন জাহিদ ইমাম। আসামি পক্ষে ছিলেন আইনজীবী তরিকুল ইসলাম, মিজানুর রহমান, গাজী এমএইচ তামিম ও মাসুদ রানা।

মামলার তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন প্রসিকিউশনের তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন। তিনিসহ মোট ১৫ জন প্রসিকিউশনের পক্ষে সাক্ষ্য দেন। আসামিপক্ষ ট্রাইব্যুনালে কোনো সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনাল গত ৬ ফেব্রুয়ারি মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রেখেছিল।

কোন অভিযোগে কী সাজা

প্রথম অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ১৫ জুন আসামি আমির, কালাম ওরফে মনসুর, জয়নাল ও কুদ্দুসসহ ২০/২৫ জন সশস্ত্র রাজাকার ৭০/৭৫ জন পাকিস্তানি সেনাকে নিয়ে নোয়াখালী জেলার সুধারাম থানাধীন শ্রীপুর ও সোনাপুর গ্রামে আক্রমণ করে এবং বাড়িঘরে লুটপাট-অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি শতাধিক নিরস্ত্র মানুষকে নির্যাতন ও হত্যা করে।

এ অভিযোগে আমির, মনসুর ও জয়নালকে মৃত্যুদণ্ড এবং কুদ্দুসকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

দ্বিতীয় অভিযোগ:  ১৯৭১ সালের ১৩ সপ্টেম্বর আসামি আমির, মনসুর ও জয়নালসহ ১৫/২০ জন রাজাকার এবং ৮/১০জন পাকিস্তানি সেনা মিলে সুধারামের পশ্চিম করিমপুর ও দেবীপুর গ্রামে আক্রমণ করে।

সেখানে তারা মুক্তিযোদ্ধা আলী আহমদকে হত্যা করে এবং মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম কালাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে তার লাশ আর পাওয়া যায়নি। মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মালেকের বাড়িঘরে সে সময় লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।

এ অভিযোগে আসামি আমির, মনসুর ও জয়নালকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

তৃতীয় অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর আমির, মনসুরসহ রাজাকার সদস্যরা এবং দেড়-দুইশ পাকিস্তানি সেনা সুধারামের রামহরিতালুক, দেবীপুর ও উত্তর চাকলা গ্রামে আক্রমণ করে।

তারা ৩০০ মানুষকে আটক করে ইউনিয়ন বোর্ড অফিসের সামনে নিয়ে নির্যাতন করে এবং তাদের মধ্যে নয় জনকে গুলি করে হত্যা করে। পাশাপাশি বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।     

এ অভিযোগে আসামি আমির ও মনসুরকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।