আক্রান্ত জাফর ইকবাল

মুক্তমনা লেখক-অধ্যাপক, ব্লগার-অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের ওপর হামলার ধারাবাহিকতায় এবার আক্রমণের শিকার হলেন অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল।

মঞ্জুর আহমদও হোসাইন ইমরানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 March 2018, 12:07 PM
Updated : 4 March 2018, 10:31 AM

সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে পুলিশের উপস্থিতিতে ছুরি নিয়ে জনপ্রিয় এই লেখকের উপর হামলা হয়। মাথায় চার জায়গায় আঘাতের পাশাপাশি বাঁ হাত ও পিঠে ছুরির জখম হয়েছে তার।

হামলার পর অধ্যাপক জাফর ইকবালকে নেওয়া হয় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে অস্ত্রোপচারের পর রাতেই তাকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে আনা হয়েছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।

জাফর ইকবালের উপর হামলার নিন্দা জানিয়ে এ ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত খুঁজে বের করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

হামলার পরপরই হামলাকারী এক তরুণকে ধরে ফেলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। ফয়জুর রহমান ফয়জুল নামের ওই তরুণ মাদ্রাসাছাত্র বলে নিজের পরিচয় দিয়েছেন। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সংলগ্ন কুমারগাঁওয়ের শেখপাড়ায় পরিবারের সঙ্গে থাকেন তিনি।

জঙ্গিদের হামলার অন্যতম লক্ষ্য জাফর ইকবাল কয়েক বছর ধরে পুলিশ পাহারা পেয়ে আসছেন; সেই পুলিশের উপস্থিতির মধ্যেই তার উপর এই হামলা হয়।

ঘটনার আগে অনুষ্ঠান মঞ্চে অধ্যাপক জাফর ইকবালের পেছনে দাঁড়ানো হামলাকারী তরুণের এই ছবি ঘুরছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে

বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ফেস্টিভাল চলছিল ক্যাম্পাসের মুক্তমঞ্চে।ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক জাফর ইকবাল; সেখানেই তার উপর হামলা হয়।

মঞ্চে বিচারকের আসনে জাফর ইকবালের সঙ্গে ইলেট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের আরও পাঁচজন শিক্ষক ছিলেন।

ইলেট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহাকারী অধ্যাপক জীবেশ কান্তি সাহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব চলছিল। হঠাৎ করে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছেলে স্যারের উপর ছুরি দিয়ে হামলা চালায়।

“আমরা শিক্ষকসহ শিক্ষার্থীরা স্যারকে উদ্ধার করে গাড়িতে করে হাসপাতালে পাঠাই। ওই ছেলেক অন্যরা আটকে বেধড়ক পিটুনি দি্য়ে একাডেমিক ভবন-২ নিয়ে আটকে রাখে।”

 

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এই বিভাগের একজন শিক্ষার্থী নাম না প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি দর্শক সারিতে ছিলাম। হঠাৎ পেছনে থাকিয়ে দেখি, স্যারের মাথা থেকে রক্ত ঝরছে। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছেলে ছুরি দিয়ে কোপ মারছে।

“তখন পাশের অন্যান্য শিক্ষার্থীরা হামলাকারীকে ধরে মঞ্চের নিচে নামিয়ে পিটুনি দেয়। আমরা স্যারকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করি।”

 বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর জহির উদ্দিন আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মঞ্চের পেছন থেকে এসে এক ছেলে ছুরি মারে গলা, বুক ও মুখের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশসহ অন্যরা তাকে আটক করে।”

ওই তরুণকে বেদম পেটানোর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন-২ এ আটকে রাখা হয়।হালকা দাড়িধারী এই তরুণকে পুলিশ ও র‌্যাব কর্মকর্তারা জিজ্ঞাসাবাদের পর সেখান থেকে র‌্যাব হেফাজতে নেওয়া হয়।

অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের উপর হামলার পর এই তরুণকে ধরে পিটুনি দেয় শিক্ষার্থীরা

এদিকে হামলাকারী তরুণের ছবি সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার তার পরিচয় শনাক্ত করেন প্রতিবেশীরা।

তারা জানান, ফয়জুর রহমান ওরফে ফয়জুল নামের এই তরুণ নিজেকে মাদ্রাসাছাত্র বলে পরিচয় দিতেন। পরিবারের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন শেখপাড়ায় থাকেন তিনি।

ফয়জুলদের গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার জগদল কালিদারকাপন এলাকায়। তার বাবা মাওলানা আতিকুর রহমান সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের পার্শ্ববর্তী টুকেরবাজারে একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন।

পরে গভীর রাতে র‌্যাব-৯ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আলী হায়দার আজাদ আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, “জিজ্ঞাসাবাদে ওই তরুণ বলেছে, জাফর ইকবাল ইসলামের শত্রু। তাই তাকে হত্যার উদ্দেশে হামলা করেছি।”

সে নিজের পরিচয় নিয়ে ‘বিভ্রান্তিকর’ দিচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “সে বলেছে, সে সিলেট আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্র। তবে আমরা মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার সত্যতা পাইনি।”

এই তরুণ কোনো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কি না তাও নিশ্চিত হতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। রাতে শেখপাড়ায় অভিযান চালিয়ে ফজলুর রহমান নামে তার এক মামাকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে জালালাবাদ থানার ওসি শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন।

জাফর ইকবালের উপর হামলার কারণ সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখনও নিশ্চিত না হতে পারলেও এতে জঙ্গিদের হাত থাকতে পারে বলেই সন্দেহ করা হচ্ছে।

জাফর ইকবাল বরাবরই জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্লগার-লেখক অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের পর একে একে অনন্ত বিজয় দাশ, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নীলয়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু ও প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনসহ বেশ কয়েকজন ব্লগার, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও ভিন্ন মতাবলম্বী খুন হন।

সে সময় অধ্যাপক জাফর ইকবালও হুমকি পাচ্ছিলেন। সেই প্রেক্ষাপটে ২০১৬ সালের অক্টোবরে তার পাহারায় পুলিশ মোতায়েন করে সরকার।

এদিকে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিং নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন জাফর ইকবাল। র‌্যাগিংয়ের দায়ে পাঁচ ছাত্রের শাস্তি দেওয়া হলে তিনি বলেছিলেন, এদের শাস্তির পরিমাণ কম হয়েছে, তাদের পুলিশে দেওয়া উচিৎ।

সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শনিবার বিকালে হামলার পর প্রথমে ওসমানি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় জাফর ইকবালকে

হামলার পর শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ-ভাংচুর করেছে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ হয়েছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।ফেইসবুকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে। পুলিশি নিরাপত্তার মধ্যে হামলা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।

ওসমানি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, “জাফর ইকবালের মাথায় চারটি আঘাত করা হয়েছে। এগুলো রডের আঘাত বলে মনে হচ্ছে। এছাড়া তার বাঁ হাত ও পিঠে ছুরিকাঘাতের জখম রয়েছে।”

জাফর ইকবালের শরীরে ২৫ থেকে ২৬টি সেলাই পড়েছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, “এখন উনি শঙ্কামুক্ত।”

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন লিটন হায়দার ও নুরুল ইসলাম হাসিব]