সীমান্তে মিয়ানমারের শক্তি বৃদ্ধি, ফাঁকা গুলি

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার হঠাৎ করে সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়ে শূন্যরেখায় অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সরে যেতে হুমকি-ধমকির পর ফাঁকা গুলিবর্ষণে ওই এলাকায় উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রাঙামাটি ও কক্সবাজার প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 March 2018, 01:15 PM
Updated : 1 March 2018, 07:33 PM

মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের এই তৎপরতাকে শূন্যরেখায় ক্যাম্প করে থাকা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পাঠানোর চেষ্টা হিসেবে দেখছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি। আতঙ্কিত ওই রোহিঙ্গারা বলছেন, তারা এখনও মিয়ানমারেও ফিরতে পারছেন না, আবার বাংলাদেশেও ঢুকতে।

এই পরিস্থিতিতে সীমান্তে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে বিজিবি। মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপিকে পতাকা বৈঠকের বার্তা পাঠিয়ে তারা। ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবাদও জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

সামরিক উপস্থিতি বাড়ানোর কারণ হিসেবে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশ ঠেকানোর কথা বলেছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ।তাদের এই বক্তব্য বাস্তব অবস্থার বিপরীত বলে মন্তব্য করছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।

তবে সীমান্তে বিজিবির সতর্ক অবস্থানের কথা জানিয়ে তিনি বলছেন, মিয়ানমারের শক্তি বৃদ্ধির বিষয়টিকে অত ‘গুরুত্ব দিয়ে দেখার কিছু নেই’।

রাখাইনে সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে পালিয়ে আসা অন্তত ১৭ হাজার রোহিঙ্গা বান্দরবান সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে আশ্রয় নিয়ে আছে। তাদের মধ্যে প্রায় সাত হাজার রোহিঙ্গা রয়েছে তুমব্রু সীমান্তের শূন্য রেখায়। তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে দুই দেশের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের সভায় মিয়ানমার আশ্বস্তও করেছিল।

বান্দরবানের স্থানীয় প্রশাসন ও বিজিবি কর্মকর্তারা জানান, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ফেব্রুয়ারির শুরু থেকেই শূন্যরেখায় অবস্থান নেওয়া রোহিঙ্গাদের সরে যেতে নানাভাবে হুমকি-ধমকি দিচ্ছিল।

সীমান্তে শূন্য রেখায় অবস্থান নেওয়া রোহিঙ্গারা

এর মধ্যে বৃহস্পতিবার সকালে হঠাৎ তুমব্রু সীমান্তে শক্তি বৃদ্ধি করে মিয়ানমার। বেশ কিছু সামরিক পিকআপ, ট্রাক ও ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিপুল সংখ্যক বিজিপি সদস্য অবস্থান নেয় শূন্য রেখা থেকে দেড়শ গজ ভেতরে।

কাঁটাতারের বেড়ার কাছে অবস্থান নিয়ে টানা কয়েক ঘণ্টা মাইকিং করে তারা রোহিঙ্গাদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। ফলে রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক  ছড়িয়ে পড়ে বলে নাইক্ষ্যংছড়ির উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সরওয়ার কামাল জানান।

তিনি বলেন, “সীমান্তের কোনাপাড়া নোম্যান্স ল্যান্ডে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সীমান্তে নিরাপত্তা বাড়িয়েছে বিজিবি ও প্রশাসন।”

ওই ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত কয়েক দিন ধরে মিয়ানমারের পুলিশ আর সেনাবাহিনী রাতের বেলায় ক্যাম্পের ঝুপড়ি ঘরে খালি মদের বোতল আর ঢিল ছুড়ে মারছে। আজ সকালে তারা গাড়ি করে অনেক লোক এনেছে। আমরা বাঁচতে চাই, মিয়ানমারে ফিরে গেলে আমাদের হত্যা করা হবে।”

বিজিবির বান্দরবান সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল আব্দুল খালেক বলেন, এর আগেও মিয়ানমার তাদের সীমান্তে লোকবল বাড়িয়ে আবার তাদের ফিরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু এবার তুমব্রু সীমান্তে এত বেশি শক্তি বৃদ্ধির কারণ স্পষ্ট নয়। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিজিবির পক্ষ থেকেও নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।

সীমান্তে শূন্য রেখায় অবস্থান নেওয়া রোহিঙ্গারা

বিজিবি ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান বলেন, “সকালে তমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখার ক্যাম্পের পাশে মিয়ানমারের ভেতরে বিজিপি অতিরিক্ত সৈন্য সমাবেশ করে। সকালে বিজিপির কয়েকটি গাড়িতে বেশ কিছু সৈন্য এখানে আসে। দুই শতাধিক সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছে। আগে থেকেও সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের আরও দুই শতাধিক সীমান্তরক্ষী মোতায়েন ছিল।”

শূন্যরেখায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের প্রতিনিধি মোহাম্মদ আরিফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সকালে বিজিপির সৈন্যরা কাঁটাতারের বেড়ার কাছে এসে অস্ত্র তাক করে রোহিঙ্গাদের সরে যেতে হুমকি দেয়।তারা কাঁটাতারের উপর মই দিয়ে ক্যাম্পে প্রবেশ করে হামলারও চেষ্টা চালায়।

“এ সময় মিয়ানমারের ভেতরে সীমান্তবর্তী বিভিন্ন পাহাড়ে ভারী অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে বিজিপি সৈন্যদের অবস্থান নিতে দেখা যায়।”

দুপুরের পর বাংলাদেশ সীমান্তে বিজিবি অবস্থান জোরদার করলে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীরা ‘ভারী অস্ত্র-শস্ত্র সরিয়ে নেয়’ বলে জানান তিনি।

এদিকে বিকালে ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত লিউন উকে তলব করে এ ঘটনার প্রতিবাদ জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সীমান্ত থেকে মিয়ানমার সৈন্যদের সরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। তারপর রাত সাড়ে ৮টার দিকে বিজিপি সদস্যরা দুই রাউন্ড ফাঁকা গুলিবর্ষণ করেন।

এরপরে এলাকাবাসীর মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে বলে ঘুনধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আজিজ চৌধুরী জানান তিনি।

আর সীমান্তে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের প্রতিনিধি আরিফ বলেন, “এসব রোহিঙ্গারা এখন না পারছে বাংলাদেশে ঢুকতে, না পারছে মিয়ানমার ফিরতে। ফলে আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হচ্ছে তাদের।”

বাংলাদেশ সীমান্তে টহলে বিজিবি সদস্যরা

সীমান্তে উত্তেজনার খবর ছড়িয়ে পড়লে বিকালে ঢাকায় পিলখানায় বিজিবি সদরদপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে আসেন এ বাহিনীর অতিরিক্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুজিবুর রহমান।

তিনি বলেন, “বর্ডার এলাকায় ভারী অস্ত্র মোতায়েন, সেনা সমাবেশ- এগুলো বর্ডার নর্মসের বাইরে। আমরা এটা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি, সতর্ক অবস্থানে আছি। যে কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে বিজিবি সব সময়ই দেশের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে।”

অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেন, বিজিবির পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে ফ্ল্যাগ মিটিং ডাকা হয়েছে। পাশাপাশি একটি প্রতিবাদলিপিও পাঠানো হয়েছে বিজিপিকে।

শূন্য রেখায় আটকে থাকা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দিতে মিয়ানমার এই তৎপরতা চালাচ্ছে কি না- এমন প্রশ্নে মুজিবুর রহমান বলেন, “কিছুদিন আগেও তারা মাইকিং করেছিল যে ‘বাংলাদেশি হয়ে’ রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের এলাকায় থাকতে পারবে না। এটা এক ধরনের পুশ-ইন এর চেষ্টাই বলা যায়।

“তবে আমি বলব, উচ্চপর্যায়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পথ অনেকটাই প্রসারিত হয়েছে। আশা করি দ্রুতই এটার নিষ্পত্তি হবে।”

মিয়ানমার সীমান্তে তাদের লোকবল কী পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে, বাংলাদেশের অন্য কোনো বাহিনীকে সীমান্তে নেওয়া হচ্ছে কিনা- এমন প্রশ্নে বিজিবির অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেন, “পরিস্থিতি এমন হয়নি যে অন্য ফোর্সকে ইনভলভ করতে হবে। এখনো পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে।”

মিয়ানমারের এ ধরনের তৎপরতাকে বাংলাদেশ ‘উসকানি’ হিসেবে দেখছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে বৈঠক হয়েছে, সমঝোতা স্মারক হয়েছে। কাজেই এটা উসকানির কোনো পর্যায়ে পড়ে না। তারা কী কারণে সেনা মোতায়েন করল তা ফ্ল্যাগ মিটিংয়েই জানা যাবে।”

বিজিবির প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ পরিদর্শনে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া সফররত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালকেও তুমব্রু পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন করেন সাংবাদিকরা।

জবাবে তিনি বলেন, মিয়ানমার দাবি করেছে, ‘জিরো লাইনে’ অবস্থান নিয়ে থাকা রোহিঙ্গারা যাতে আর বাংলাদেশে না ঢোকে সেজন্যই তারা নিরাপত্তা বাড়িয়েছে।

“দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি… ১৯৭৮ এ দেখেছি, ৯১ তে দেখেছি, ২০১৬ সালে দেখেছি, ২০১৭-১৮ তেও দেখছি। তারা যা বলেন, তা তারা করেন না। আজকে তারা যে এক্সকিউজ দিতে চাচ্ছেন, তা ভুল দিচ্ছেন। এগুলো আমরা দেখেছি। বিজিবি অত্যন্ত সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। আমাদের এলাকায় তাদের ঢুকতে দেওয়া হবে না।”

মিয়ানমারের বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধির বিষয়টিকে ‘বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখার কিছু নেই’ মন্তব্য করে মন্ত্রী বলেন, “আমাদের বিজিবি সবসময় সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।… দেশের ভেতরে এসে কেউ কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা করবে- এটা অসম্ভব।”