বঙ্গবন্ধু-প্রধানমন্ত্রীকে ‘বাজে মন্তব্যে’ মেলায় বই জব্দ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে ‘বাজে মন্তব্য’ থাকায় ‘বেঙ্গল কেমিস্ট্রি’ নামের একটি বই জব্দ করেছে গ্রন্থমেলার নীতিমালা ভঙ্গ ও বইয়ের মান বিচারে গঠিত বিশেষ টাস্কফোর্স।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Feb 2018, 05:04 PM
Updated : 25 Feb 2018, 05:07 PM

এছাড়া মেলায় নিম্ন মানের বই আনা এবং বিদেশি কার্টুন চরিত্রের বই প্রকাশকারী কয়েকটি প্রকাশনীকে এসব কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে তারা।

মেলার ২৫তম দিন রোববার এসব ব্যবস্থা নেওয়ার পর টাস্কফোর্সের সদস্য সচিব বাংলা একাডেমির কর্মকর্তা তপন বাগচী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মশিউর রহমান তৌহিদের লেখা ‘বেঙ্গল কেমিস্ট্রি’ বইটি আলীগড় প্রকাশনীর স্টলে বিক্রি হচ্ছিল। এই বইয়ে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে ‘আজেবাজে মন্তব্য’ থাকায় বইটি জব্দ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, “বইয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আজেবাজে মন্তব্য তো রয়েছেই, পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য রয়েছে। তার নাম বিকৃত করা হয়েছে। এছাড়া বইটি আলীগড় প্রকাশনীরও নয়, পরিবেশকও তারা নন। নীতিমালা অনুযায়ী, প্রকাশক বা পরিবেশক না হলে, সেই স্টল থেকে এমন বই বিক্রি নিষিদ্ধ।”

বইটি নিয়ে এর আগে ওই প্রকাশনীকে মৌখিকভাবে সতর্ক করা হয়েছিল জানিয়ে বাংলা একাডেমির এই কর্মকর্তা বলেন, ওই প্রকাশনীকে পরবর্তীতে মেলায় স্টল বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য গ্রন্থমেলা পরিচালনা কমিটির কাছে সুপারিশ করেছেন তারা।

মেলায় অভিযান চালিয়ে চিরন্তন প্রকাশনী ও রাবেয়া বুকসে কোনো মৌলিক বই খুঁজে না পাওয়ার কথা জানান তপন বাগচী।

তিনি বলেন, “রাবেয়া বুকসে অধিকাংশ ধর্মীয় বই। এখানে সৃজনশীল কোনো বই আমরা খুঁজে পেলাম না। মেলায় অংশগ্রহণের প্রধান শর্তই তারা মানেনি। চিরন্তনে সৃজনশীল বই একটিও নেই।  নিজস্ব প্রকাশনা নেই তাদের। অনেকগুলো পাইরেটেড বই পেয়েছি, যা তারা নিজেদের নামে প্রকাশ করেছে।”

চিরন্তন ও রাবেয়া প্রকাশনীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয়েছে।এছাড়া নীতিমালা ভেঙে মেলাপ্রাঙ্গণে লিফলেট বিতরণ করায় দোয়েল প্রকাশনীকে মৌখিকভাবে সতর্ক করা হয়েছে।পাশাপাশি এই স্টলকে বাকি তিনটির মতো কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

তরুণ লেখকদের নিয়ে আশাবাদ

মেলায় আসা তরুণ লেখকদের বই পড়ে আশাবাদী হয়ে উঠেছেন কথাসাহিত্যিক আহমদ মোস্তফা কামাল।

মেলাপ্রাঙ্গণে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি বলেন, “বাংলা কথাসাহিত্যে প্রবীণদের লেখা ক্রমশ কমে এলেও তরুণরা কথাসাহিত্যের ধারা বয়ে চলেছেন। তরুণ প্রজন্মের লেখা পড়ে সত্যিই আশাবাদী হয়ে উঠি।

“বলা হচ্ছিল, সিনিয়র সাহিত্যিকরা যখন একের পর এক চলে যাচ্ছেন, একটি শূন্যতা তৈরি হবে। আমি মনে করি, তা হবে না। কারণ তরুণরা  বাংলা ভাষাকে নিয়ে নানা প্রকরণে যেভাবে সাহিত্য রচনায় ব্রতী হয়েছে, তাতে আমি মনে করি কথাসাহিত্যের ধারাটি বয়ে যাবে।”

এবার বইমেলায় আহমদ মোস্তফা কামালের তিনটি বই- মুক্তগদ্যের বই ‘যেভাবে কবিতা পড়ি’, উপন্যাস ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ এবং গল্পগ্রন্থ ‘দ্বিধা, ভয় ও উদাসীনতার গল্প’।

মূল মঞ্চের আয়োজন  

এদিন বইমেলার মূল মঞ্চে ছিল ভাষাসংগ্রামী নাদেরা বেগম, মমতাজ বেগম এবং একুশের শহীদ মিনারের অন্যতম রূপকার নভেরা আহমেদকে নিয়ে আলোচনা।

নির্ধারিত প্রবন্ধকার রামেন্দু মজুমদার বিদেশে থাকায় তার লেখা ‘ভাষাসংগ্রামী নাদেরা বেগম’ পাঠ করেন মেয়ে ত্রপা মজুমদার। ‘ভাষাসংগ্রামী মমতাজ বেগম’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রফিউর রাব্বি এবং ‘একুশের শহীদ মিনারের অন্যতম রূপকার নভেরা আহমেদ’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রেজাউল করিম সুমন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন শফি আহমেদ ও মালেকা বেগম। সভাপতিত্ব করেন সৈয়দ আবুল মকসুদ।

ভাষাসংগ্রামী নাদেরা বেগম সম্পর্কে রামেন্দু মজুমদার লিখেছেন, “আমাদের ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বের ইতিহাসে এক সাহসী ও সংগ্রামী নারী হিসেবে নাদেরা বেগমের নাম উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। তবে এটা স্বীকার করতে হবে যে, তার সে সময়ের অসাধারণ ভূমিকার কোনো স্বীকৃতি তিনি পাননি।”

প্রবন্ধে রফিউর রাব্বি বলেন, “ভাষা আন্দোলনে যেসব নারীর নাম উচ্চারিত হয়ে থাকে তাদের মধ্যে মমতাজ বেগম সর্বাগ্রে। এটি শুধু নারায়ণগঞ্জের প্রশ্নে নয়, দেশের সামগ্রিক আন্দোলনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

“ভাষা আন্দোলনে তার ভূমিকা ও অবদান এবং পরে মৃত্যু অবধি পরিচালিত তার আদর্শিক লড়াই- এ এক অনন্য উপাখ্যান। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তার সমস্ত জীবন সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত হয়ে যায়, সংসার ভেঙে যায়। আমাদের সংগ্রামের ইতিহাসে এ এক বিরল উদাহরণ। তার আত্মত্যাগ যুগ-যুগ আমাদের অনুপ্রেরণা যোগাবে।”

ভাস্কর নভেরা আহমেদকে নিয়ে রেজাউল করিম সুমন বলেন, “বাঙালির সংগ্রাম ও গৌরবের প্রতীক এই শহীদ মিনার যত দিন থাকবে ততদিন এর অন্যতম স্থপতি নভেরা আহমেদকেও জাতি স্মরণ করবে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়। ”

সভাপতির বক্তব্যে সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, “ভাষা আন্দোলনে নারী-পুরুষ সবারই গৌরবজনক অংশগ্রহণ ছিল।ইতিহাসের পূর্ণতার স্বার্থে সবার অবদান আলোচিত হওয়া প্রয়োজন।

“পঞ্চাশের দশকে যখন আমাদের সমাজে নারীদের বাইরে বেরোনোর ব্যাপারে কড়াকড়ি ছিল ঠিক সেই সময় এই নারীরা রাস্তায় শুধু বেরই হননি, তারা ভাষার জন্য অসীম সাহসে সংগ্রামও করেছেন।”

নতুন বই

বাংলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এদিন মেলায় ১০৭টি নতুন বই এসেছে। এগুলোর মধ্যে শ্রাবণ প্রকাশনী থেকে এসেছে মফিজ ইমাম মিলনের ইতিহাসের বই ‘অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষ সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ’, পাঠশালা এনেছে সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের গল্পগ্রন্থ ‘শিল্প সাহিত্যে শেখ মুজিব’, উৎস প্রকাশন এনেছে ফয়জুল ইসলাম ফজলুর প্রবন্ধ সংকলন ‘বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি, ছাত্রলীগ ও আমি’, আগামী থেকে এসেছে বদিউল আলম মজুমদারের প্রবন্ধ সংকলন ‘সমকালীন রাজনীতি ও উন্নয়ন ভাবনা’,  অ্যাডর্ন থেকে এসেছে অরূপ রতন চৌধুরীর ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ স্মৃতিচারণ বইটি।

এছাড়া পাঞ্জেরি পাবলিকেশন্স থেকে এসেছে শামসুজ্জামান খানের কিশোর গল্পগ্রন্থ ‘রঙ্গরসের গল্প’। বাংলা একাডেমি থেকে এসেছে শায়লা পারভীনের গবেষণার বই ‘উনিশ, বিশ শতকে পুরনো ঢাকার সমাজ ও সংস্কৃতি’। দেশ পাবলিকেশন্স থেকে এসেছে জাহাঙ্গীর সুরের বিজ্ঞানের বই ‘শূন্য মহাশূন্য বলি যারে’। অনন্যা এনেছে হাসান হাফিজের কবিতার বই ‘একুশের কবিতা’, সাহিত্যকথা এনেছে মো. আরিফুল হুদার কবিতার বই ‘আত্মদান’, আগামী এনেছে বিধান চন্দ্র পালের কবিতার বই ‘আবার জেগে উঠবে মানুষ’, দেশ পাবলিকেশন্স থেকে এসেছে রবিউল করিম মৃদুলের ‘জলপাই রঙের কোট’, কথাপ্রকাশ থেকে এসেছে আহমেদ লিপুর দর্শনের বই ‘ব্যক্তিকতায় নৈর্ব্যক্তিক’।

তথ্যমন্ত্রীর ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিষবৃক্ষ’

তথ্যমন্ত্রী ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর প্রবন্ধ সংকলন ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিষবৃক্ষ’ রোববার বইমেলায় এসেছে।

সংকলন গ্রন্থটির মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে এসে তথ্যমন্ত্রী বলেন, “যুদ্ধাপরাধী-জামাত-জঙ্গিবাদীরা এদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ডালপালা। আর পঁচাত্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর জন্ম নেওয়া বিএনপি হচ্ছে রাজনীতির বিষবৃক্ষ। এ বিষবৃক্ষই জঙ্গিবাদের লালনকারী।

“সে কারণে জঙ্গিবাদ ও  সাম্প্রদায়িকতার কবল থেকে মুক্ত করে দেশকে শান্তি, গণতন্ত্র ও উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে শুধু ডালপালা ছাঁটলেই হবে না, রাজনীতির বিষবৃক্ষও উপড়ে ফেলতে হবে।”

অনার্য প্রকাশনী থেকে আসা প্রবন্ধ সংকলনে ১৭টি প্রবন্ধ রয়েছে।