২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে নিয়ে একুশের বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে জঙ্গি কায়দায় হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী অভিজিৎ। চাপাতির আঘাতে আঙুল হারান বন্যা।
লেখালেখির কারণে আগে থেকেই ধর্মীয় উগ্রবাদীদের হুমকির মুখে ছিলেন প্রকৌশলী অভিজিৎ। তারই ধারাবাহিকতায় এ খুন বলে পরে জানায় পুলিশ।
ঘটনার পরদিন শাহবাগ থানায় মামলা করেন অভিজিতের বাবা। এরপর বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার ও জিজ্ঞাসাবাদের খবর এলেও তিন বছরেও মামলার অভিযোগপত্র দিতে পারেনি পুলিশ।
গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক ও আইনজীবী জীবনানন্দ জয়ন্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন, অনেকবার পেছানোর পর গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ছিল তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ। কিন্তু সেদিনও ব্যর্থ হওয়ায় বিচারক ১৫ মার্চ নতুন তারিখ রেখেছেন।
সবমিলিয়ে এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমার তারিখ ৩২ বার পিছিয়েছে বলে জানান তিনি।
আইনজীবী জয়ন্ত বলেন, “তদন্ত প্রতিবেদন ৩২ বার পিছিয়ে যাওয়ার অর্থ পুলিশের ব্যর্থতা। হামলা ঠেকাতে ব্যর্থতার মতো এটাও তাদের ব্যর্থতা।”
ছেলের মৃত্যুর তৃতীয় বছর পেরুনোর আগে রোববার বেইলি রোডের বাসায় কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক অজয় রায়ের সঙ্গে।
মামলার তদন্ত নিয়ে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি তো আশার মানুষ, আশা নিয়েই বেঁচে থাকি। আমি ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করছি, এতদিন করছি- দেখি। বিচার হলে দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে। বিচারহীনতা দেশের সুনাম আনে না।”
তিনি বলেন, “…এতেই দুর্বলতা প্রকাশ হয় যে, আমাদের ইনভেস্টিগেশন অথরিটির হয় সামর্থ্যের প্রশ্ন তুলতে হয়, আর না হয় গাছাড়া ভাবের কথা তুলতে হয়। কোনোটাই অগ্রসর হচ্ছে না। সিনসিয়ারলি যদি কাজ না করে তাহলে তো অগ্রগতি হয় না।”
তদন্ত নিয়ে কতটুকু আশাবাদী জানতে চাইলে অজয় রায় বলেন, “আশা নিরাশার প্রশ্ন না। প্রশ্নটা হচ্ছে শুধু আমি অভিজিতের বাবা হিসেবে নয়, এদেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে- আমি চাইব যারা গুরুতর অপরাধের সঙ্গে জড়িত তাদের অপরাধ তদন্তটা দ্রুত হবে এবং সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে।
“সাধারণ গুণ্ডা, ডাকাত, চোর ও দস্যুর সঙ্গে যদি গুলিয়ে ফেলে তাহলে তো আর হবে না। এতে সরকারের ব্যর্থতাও প্রতিফলিত হয়। শুধু ইনভেস্টিগেশন বিভাগের না বা আইজিপির না, সরকার প্রধানের ব্যর্থতাও প্রতিফলিত হয়।”
মামলার তদন্তের বিষয়ে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) প্রধান মো. মনিরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, প্রথমে গোয়েন্দা পুলিশ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করেছিল। গত বছরের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে সিটিটিসি তদন্ত করছে।
তিনি বলেন, এই পর্যন্ত অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে জড়িত নয়জনকে সনাক্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে ‘গোলাগুলিতে’ মারা গেছেন, আর তিনজনকে সিটিটিসি গ্রেপ্তার করেছে এবং বাকি পাঁচজন পলাতক।
সিটিটিসির হাতে গ্রেপ্তাররা হলেন- মোজাম্মেল হোসেন সায়মন, আবু সিদ্দিক সোহেল ও আরাফাত ওরফে সমছ ওরফে সাজ্জাদ। গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে ‘গোলাগুলিতে’ নিহত হন মুকুল রানা।
মনিরুল বলেন, “আগে র্যাব কর্তৃক সাতজন গ্রেপ্তার হয়েছিল। পরে গোয়েন্দা পুলিশ তাদেরকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছিল। তবে এখনও এই ঘটনায় এই সাতজনের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। কিন্তু সিটিটিসির হাতে গ্রেপ্তার হওয়া তিনজন এই ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে।
“এই তিনজনসহ কয়েকজনের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছিলাম। তিনজনকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে মূলত এই মামলার রহস্য উদঘাটিত হয়েছে।”
মামলার তদন্ত ‘শেষ করে আনা হয়েছে’ দাবি করে তিনি বলেন, “আশা করি খুব তাড়াতাড়ি চার্জশিট দাখিল করতে পারব।”
আনসার আল ইসলামের সদস্যরাই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে দাবি করে মনিরুল বলেন, “তদন্তে বের হয়ে এসেছে সংগঠনের প্রধান বরখাস্ত মেজর জিয়া সরাসরি সম্পৃক্ত এবং হত্যাকাণ্ডের সময় উপস্থিত ছিল।
“পলাতকদের গ্রেপ্তার করা না গেলেও অন্তত এখন পর্যন্ত তদন্তে যা পাওয়া গেছে, তাতেই এই মামলার বিচার চালানোর মতো সাক্ষ্য ও তথ্য-প্রমাণ আমাদের হাতে এসেছে। বেশিদিন এই মামলাটি ধরে না রেখে খুব তাড়াতাড়ি চার্জশিট দাখিল করব।”
সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ মেজর জিয়া সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই পুলিশের কাছে।
মনিরুল বলেন, “আমাদের কাছে সে পলাতক বলেই তথ্য রয়েছে। গত কয়েকমাস আগে দেশে ছিল বলে তথ্য পাওয়া গেছে। বর্তমানে সে দেশে আছে না বিদেশে আছে সুনির্দিষ্ট তথ্য নাই। তবে আমরা বিশ্বাস করি যদি দেশে থাকত বা সক্রিয় থাকত তাহলে কোনো না কোনোভাবে আমরা তথ্য পেতাম।”