বন্য হাতি-সাপের ভয় নিয়ে বেড়ে উঠছে রোহিঙ্গা শিশুরা

টয়লেট ব্যবহারের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার মধ্যে যৌন হয়রানিসহ ক্যাম্পে নানা সমস্যার সঙ্গে রোহিঙ্গা শিশুদের নিত্যদিনের সঙ্গী বন্য হাতি আর সাপের ভয়-এমন চিত্রই উঠে এসেছে একটি গবেষণায়।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Feb 2018, 01:24 PM
Updated : 25 Feb 2018, 01:57 PM

মিয়ানমারের রাখাইনে সেনা সদস্যদের হত্যাযজ্ঞের মুখে পালিয়ে আসা কয়েক লাখ রোহিঙ্গার আশ্রয় হয়েছে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং আশ্রয় শিবিরে। স্বল্প পরিসরে বিপুল সংখ্যক মানুষের রান্নার জ্বালানি আসছে ক্যাম্প সংলগ্ন বন থেকে; যেখানে বন্য হাতি, সাপ আর বনরক্ষীর আক্রমণের শঙ্কা নিয়ে কাঠ সংগ্রহের দায়িত্বে এই শিশুরা। 

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢলের ছয় মাস অন্তে কক্সবাজারের শরণার্থী ক্যাম্পে শিশুদের নিয়ে কাজ করা তিনটি সংস্থার যৌথ গবেষণায় তাদের আতঙ্কভরা শৈশবের বিবরণ এসেছে।

শিশুদের এই অবস্থা নিয়ে বিচলিত উন্নয়ন সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের কান্ট্রি ডিরেক্টর মার্ক পিয়ার্স বলেছেন, “ক্যাম্পে অবস্থানরত শিশুরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ও নাজুক। এই অভিজ্ঞতার সঙ্গে অনিরাপত্তা তাদের মধ্যে নতুন ভীতি সঞ্চার করেছে।... কোন শিশুর এমন অমানবিক বেঁচে থাকা কাম্য নয়।”

নিজেরাই শিশু, এখন রূঢ় বাস্তবে এসে পরিবারে ছোটদের সামলাতে হচ্ছে তাদের। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

সেভ দ্য চিলড্রেনের সঙ্গে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ও ওয়ার্ল্ড ভিশন মিলে রোহিঙ্গা শিশুদের অবস্থা নিয়ে এই গবেষণা করে। ‘আশঙ্কিত শৈশব: বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শিশুদের ছয় মাস’ শীর্ষক ওই গবেষণা প্রতিবেদন রোববার ঢাকায় একটি হোটেলে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়।

তিন প্রতিষ্ঠানের যৌথ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানের বিস্তারিত জানানো হয়। অনুষ্ঠানে গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরেন সেভ দ্য চিলড্রেনের প্রোগ্রাম ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কোয়ালিটি বিভাগের পরিচালক রিফাত বিন সাত্তার।

তিনি জানান, কক্সবাজারে উখিয়ার ক্যাম্প এলাকায় ২০০ রোহিঙ্গা ও স্থানীয় শিশু এবং তাদের ৪০ জন মায়ের সঙ্গে কথা বলেছেন গবেষকরা।

রিফাত বিন সাত্তার বলেন, “অধিকাংশ শিশুই জঙ্গলে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে। তারা বলে, বনরক্ষীরা তাদের অনেক সময় লাঠি দিয়ে আক্রমণ করে, অনেক সময় শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার হয়; পাশাপাশি বন্য হাতি আর সাপের ভয় নিত্যদিনের সঙ্গী।”

জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেকের ধর্ষিত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি।

ক্যাম্পে শিশুদের ‘মানবেতর’ জীবনের তথ্য গবেষণায় উঠে আসার কথা উল্লেখ করে রিফাত বলেন, “টয়লেট ব্যবহারের সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করার কথা উল্লেখ করে পুরুষ দ্বারা হয়রানির অভিজ্ঞতা প্রকাশ করেছে মেয়েরা।

“বাঁশ ও পলিথিনের তৈরি তাঁবুতে বিভিন্ন সময় চোরের উপদ্রব এবং তাঁবুতে থাকা শেষ সম্বলগুলো হারানোর কথা জানিয়েছে শিশুরা।”

গত অগাস্ট থেকে এখন পর্যন্ত আটটি শিশু পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এর প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি বলে ধারণা করছে সংশ্লিষ্ট সেবা প্রদানকারী সংস্থার কর্মীরা।”

রিফাত বিন সাত্তার বলেন, “তাদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল- ক্যাম্পে কোন বিষয়টি শিশুদের নিয়ে উদ্বেগের কারণ? রান্নার কাঠ সংগ্রহ, স্বল্প পরিসরে থাকার জায়গা এবং শিক্ষার সুযোগের অভাবকেই সবাই বড় ধরনের সমস্যা বলে চিহ্নিত করেন।”

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের কান্ট্রি ডিরেক্টর অরলা মারফি বলেন, “রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শিশুরা তাদের নিজস্ব পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এমন একটি পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছে যেখানে তারা ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, নিরাপদ খেলার জায়গা, খাদ্য নিরাপত্তা, বিশৃঙ্খল ঘনবসতিপূর্ণ ভীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন।”

ওয়ার্ল্ড ভিশনের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফ্রেড উইটিভেন বলেন, “কক্সবাজারে শরণার্থী ক্যাম্পে তাদের জীবনব্যবস্থা আমাদের বিচলিত করে। তারা তো অনেক কিছু চাচ্ছে না। রাতে পর্যাপ্ত আলো, তাদের নিরাপদ টয়লেট ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়া, যথাযথ আশ্রয়ের ব্যবস্থা তাদের মধ্যে নিরাপদ বোধ জাগ্রত করে এবং শিক্ষার সুযোগ প্রসারিত করা।”

অনুষ্ঠানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন।