খালেদার জামিনের অপেক্ষা ফুরাচ্ছে না

জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় জামিন প্রশ্নে হাই কোর্টে শুনানি শেষ হলেও কারাবন্দি খালেদা জিয়ার অপেক্ষা এখনই ফুরাচ্ছে না।  

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Feb 2018, 09:56 AM
Updated : 25 Feb 2018, 01:01 PM

রোববার দুপুরে এক ঘণ্টার বেশি সময় শুনানি করে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের হাই কোর্ট বেঞ্চ বলেছে, জজ আদালত থেকে এ মামলার নথি এলে তা দেখে আদালত আদেশ দেবে।

গত ২২ ফেব্রুয়ারি একই বেঞ্চ খালেদা জিয়ার আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করে আদেশ পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে বিচারিক আদালত থেকে মামলার নথি পাঠাতে নির্দেশ দিয়েছিল। সেই আদেশ নিম্ন আদালতে গেছে রোববার। ফলে খালেদা জিয়া জামিন পাবেন কি না- তা জানতে আরও অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এতিমখানা দুর্নীতি মামলা ছাড়াও ৩৪টি মামলা রয়েছে দেশের বিভিন্ন আদালতে। সেসব মামলার তাকে এখনও গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি।

ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আখতারুজ্জামান গত ৮ ফেব্রুয়ারি এ মামলার রায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন।

খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানসহ অপর পাঁচ আসামির প্রত্যেককে ১০ বছরের জেল এবং আসামিদের প্রত্যেককে ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার করে জরিমানা করা হয় রায়ে।

পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, সরকারি এতিম তহবিলের টাকা এতিমদের কল্যাণে ব্যয় না করে পরস্পর যোগসাজশে আত্মসাৎ করে খালেদা জিয়াসহ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার আসামিরা রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক অপরাধ করেছেন।

১১৬৮ পৃষ্ঠার ওই রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি হাতে পাওয়ার পর গত ২০ ফেব্রুয়ারি হাই কোর্টে আপিল করেন বিএনপি চেয়ারপারসনের আইনজীবীরা। ২২ ফেব্রুয়ারি বিষয়টি আদালতে উঠলে তখনই জামিন আবেদন করা হয়।

মূল রায়সহ ১২২৩ পৃষ্ঠার আপিল আবেদনে ৪৪টি যুক্তি দেখিয়ে খালেদা জিয়ার খালাস চাওয়া হয়। আর ৮৮০ পৃষ্ঠার জামিন আবেদনের মধ্যে ৪৮ পৃষ্ঠাজুড়ে ৩২টি যুক্তিতে খালেদা জিয়ার মুক্তি চাওয়া হয়।

সেদিন শুনানি শেষে বিএনপি চেয়ারপারসনের আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করে নিম্ন আদালতের দেওয়া অর্থদণ্ড আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত করে হাই কোর্ট।

কিন্তু জামিন আবেদনের কপি পেতে বিলম্বের কারণ দেখিয়ে দুদক শুনানির জন্য সময় চাইলে হাই কোর্ট রোববার দুপুরে শুনানির সময় ঠিক করে দেয়। 

শুনানিতে যা হল

বেলা ২টায় জামিন শুনানি শুরুর আগেই বিএনপিপন্থি বিপুল সংখ্যক আইনজীবী আদালত কক্ষে উপস্থিত হলে হই চই শুরু হয়। দুই বিচারক বেলা সোয়া ২টার দিকে যখন বেঞ্চে বসলেন আদালতকক্ষ তখন তিল ধারণের জায়গা ছিল না।

এ পরিস্থিতিতে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক দুই পক্ষের আইনজীবীদের বলেন, এত হট্টগোল হলে শুনানি করা যাবে না।

খালেদা জিয়ার আইনজীবী সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি জয়নুল আবেদীন এ সময় বলেন, এটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা বলে আইনজীবীরা এসেছেন। তারা কেউ কোনো শব্দ করবেন না।

বিচারক তখন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা বাদে অন্যদের আদালত কক্ষের বাইরে চলে যেতে বলেন এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে দশ মিনিট সময় দিয়ে এজলাস থেকে নেমে যান।  

দুই বিচারক তাদের খাস কামরায় চলে যাওয়ার পর বিএনপিপন্থি জুনিয়ার আইনজীবীরা আদালত কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান। বেলা আড়াইটায় বিচারকরা বেঞ্চে ফেরেন এবং জামিন শুনানি শুরু হয়।

আদালতে খালেদা জিয়ার পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী। রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এবং দুদকের পক্ষে খুরশীদ আলম খান শুনানি করেন।

খালেদা জিয়ার জামিনের আরজি জানিয়ে এ জে মোহাম্মদ আলী শুনানিতে বলেন, “মামলায় পাঁচ বছরের যে সাজা দেওয়া হয়েছে, তা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত সাজা। এই আদালতের রীতি এবং ক্ষমতা আছে সংক্ষিপ্ত সাজায় জামিন দেওয়ার। তাছাড়া তিনি একজন বয়স্ক নারী। তাই আমরা তার জামিন চাচ্ছি।”

এর বিরোধিতা করে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, সংক্ষিপ্ত সাজায় জামিন পেতে পারে এটা কোনো যুক্তি হতে পারে না। খালেদা জিয়া একজন বয়স্ক নারী এবং তিনি অসুস্থ বলে আসামিপক্ষ যুক্তি দেখালেও তার সমর্থনে কোনো মেডিকেল সার্টিফিকেট বা কাগজপত্র দাখিল করেনি।

“ফলে তিনি জামিন পেতে পারেন না। বরং উচ্চ আদালত এ মামলায় বিচারিক আদালতের যে নথি তলব করেছে, তা এলে পরে এ বিষয়ে আদেশ হতে পারে।”

রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও শুনানিতে খালেদা জিয়ার জামিনের বিরোধিতা করেন।

তিনি বলেন, খালেদা জিয়া নিম্ন আদালতে ১০৯ বার বিভিন্ন অজুহাতে সময় নিয়েছেন। মামলা বাতিল চেয়ে, অভিযোগ থেকে অব্যাহতি চেয়ে, আদালত পরিবর্তন চেয়ে বা বিচারকের প্রতি অনাস্থা জানানোসহ নানা কারণে ২৬ বার উচ্চ আদালতে এসেছেন।

“মোট কথা নয় বছরের মত সময় লেগেছে মামলাটি শেষ হতে। ফলে আজকে যদি জামিন দিয়ে দেন, তাহলে বলা যাচ্ছে না আদৌ এর আপিল শুনানি হবে কি না।”

দ্রততম সময়ে আপিল শুনানি শুরুর তাগিদ দিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “অত্যাধুনিক প্রযুক্তি রয়েছে। আপিল শুনানির জন্য এক মাসের মধ্যে পেপারবুক প্রস্তুত হতে পারে। যেমন বিডিআর বিদ্রোহ মামলার আপিলের ক্ষেত্রে প্রস্তুত করা হয়েছিল। আমাদের কোর্টের সে প্রযুক্তি আছে। তাই আমার আবেদন হচ্ছে, জামিন না দিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আপিল শুনানি শুরু করা হোক।”

শুনানি শেষে বিচারক বলেন, “জামিন বিষয়ে শুনানি শেষে হয়েছে। বিচারিক আদালতের নথি এলে পরে এ বিষয়ে আদেশ দেওয়া হবে।” 

খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের মধ্যে ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এএফএম হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন জামিন শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন।

বিএনপি নেতাদের মধ্যে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ড. মঈন খান ও মির্জা আব্বাস ও খায়রুল কবির খোকনকেও আদালতে দেখা যায়।

‘এরশাদ জামিন পান সাড়ে তিন বছরে’

শুনানির পর দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান সাংবাদিকদের বলেন, “আমাদের আপিল বিভাগে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদের একটি রায় আছে। সে রায় অনুযায়ী আসামির শর্ট প্রিজন হলে জামিন না দিয়ে আপিল নিষ্পত্তির নির্দেশনা আছে। যদি দেখা যায় কোনো কারণে আপিল শুনানি হচ্ছে না বা বিলম্ব হচ্ছে, কেবল তখন জামিনের বিষয়টি কনসিডার করতে হবে।”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়া দুই মাস সাত দিন জেলে থেকেছেন।

“২০০৮ সালের ২৩ জুলাই এ মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছিল। ওই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি জামিনে বের হয়ে এসেছিলেন। সে হিসাবে ওই সময় তিনি এ মামলায় ৫০ দিন কারাভোগ করেছিলেন। আর রায়ের পর আজ পর্যন্ত ১৭ দিন, অর্থাৎ মোট ৬৭ দিন তিনি জেলে আছেন।”

খুরশীদ আলম খান বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আদেশ পাওয়ার পনের দিনের মধ্যে বিচারিক আদালতকে নথি পাঠানোর যে আদেশ গত বৃহস্পতিবার হাই কোর্ট দিয়েছিল, সে আদেশটি বিচারিক আদালত আজ পেয়েছে। নথি পাঠানোর জন্য প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে। ঠিক কবে এ নথি উচ্চ আদালতে আসবে তা বলা যাচ্ছে না।”

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, “এ মামলার আপিলটি নিম্ন আদালতের মত দেরি হোক, আমি তা চাই না। তাই বলেছি, নিম্ন আদালতের নথি আসুক, সুপ্রিম কোর্টে অনেক মেশিন আছে। অতি অল্প সময়ে পেপারবুক তৈরি করা হবে এবং পেপারবুক শুনানির পর মামলাটা দ্রুত নিষ্পত্তি করা যাবে।”

সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের দুর্নীতি মামলায় জেল খাটার প্রসঙ্গ টেনে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “আগের একজন সরকার প্রধান হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদকে পাঁচ বছরের সাজা দেওয়া হয়েছিল। সাড়ে তিন বছর পর তিনি জামিন পেয়েছিলেন। তাই আরেকজন সাবেক সরকার প্রধান কেন দুই মাসের মধ্যেই জামিনপ্রাপ্ত হবেন?”