তারা শপথ নিয়েছেন, বাংলা ভাষার মর্যাদা এতটুকু মলিন হতে দেবেন না তারা, সইবেন না বর্ণমালার বিকৃতি।
ডেফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিবিএ ও ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্টের শিক্ষার্থী জাইম, শিহাব, রুবেল, নাদিম ও নাজমুলরা একুশের সকালে এসেছিলেন বইমেলায়।
জাইম জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভলান্টিয়ার সার্ভিস ক্লাবের পক্ষ থেকে এ বছর তারা হতদরিদ্র শিশুদের হাতে বই তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। এই বইগুলোর মধ্যে গল্প-উপন্যাস যেমন থাকবে তেমনি ইতিহাস-ঐতিহ্যও।
“বই মেলা ঘুরে সেসব বই জোগাড় করছি। হয়তো খুব বড় পরিসরে কাজ করতে পারছি না। কিন্তু আমরা ভাষার প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করব বলেই প্রতিজ্ঞা করেছি,” বলেন তিনি।
নাদিম বলেন, “ভিনদেশি ভাষাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে আমরা বাংলাকে ভুলতে বসেছি। প্রমিত বাংলার চর্চা কেমন যেন স্তিমিত হয়ে গেছে। আমরা প্রমিত বাংলার চর্চা করব, শুদ্ধ বাংলায় কথা বলব। বাংলার এতটুকু বিকৃতি আমরা সইব না।”
ভুল বানান, অশুদ্ধ বাক্যরীতিতে ভরপুর একাধিক বই যাচাই করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক মোবাশ্বেরা খানম বলেন, “যে একুশের চেতনা ছড়িয়ে দিতে এই বইমেলার আয়োজন করা হয়েছে, সেই বইমেলাতেই এমন ভুলভাল বই এলে তরুণ প্রজন্মের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছাবে। এ বিষয়টি নিয়ে প্রকাশকদের সতর্ক থাকা উচিৎ ছিল।”
গেন্ডারিয়া থেকে দুই মেয়ে সুমাইয়া ও মেহেরিনকে নিয়ে মেলায় আসা সাদিয়া আক্তার জানান, তার বাবা আবদুল মোতালেব ব্যাপারী নিজের জীবন বিপন্ন করে একাত্তরের রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য সহায়তা করেছিলেন।
সাদিয়া বলেন, “আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। কিন্তু বাবার মুখ থেকে মুক্তিযুদ্ধের অনেক গল্প শুনেছি। বাবার বীরত্বের গল্পগুলো শুনে কখনো গর্বে বুক ফুলে উঠে, কখনো আত্মদানের কথা শুনে চোখ ভিজে উঠে। সেই থেকে আমি মুক্তিযুদ্ধের বইয়ের প্রতি বরাবরই দুর্বল। এবারও সেসব বই কিনব। মেয়েরা এখনো অনেক ছোট। কিন্তু ওদের আমি গল্পে গল্পে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাই। ওরা জানুক, কিভাবে আমাদের দেশটা স্বাধীন হয়েছিল, বাংলা কেমন করে আমাদের মাতৃভাষা হয়েছিল।”
বাসাবো থেকে আসা মো. আব্দুল মমিন জানান, তিনি তার দুই সন্তান জিহাদ ও মাইশাকে বাংলা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যবিষয়ক বই কিনে দেবেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শেফাউল করিম বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি তখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। আমার শৈশবের স্মৃতিগুলো এতটুকু ভুলিনি। ছেলেমেয়েদের প্রতিবারই শহীদ মিনারে নিয়ে আসি। সেখান থেকে সোজা আসি বইমেলায়।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর পাবলিশিং লিমিটেডের (বিপিএল) স্টলে বই কিনতে এসে সফটওয়্যার প্রকৌশলী ইয়াসির আরাফাত বলেন, “ছোট্ট নাবিহার কত প্রশ্ন! নানা প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে আমি ওকে নিয়ে বইমেলায় চলে এসেছি। ভাষা আন্দোলন নিয়ে বই খুঁজছি। এসব বই থেকে পড়ে যা জানব, পরে ওকে শোনাব।”
দুপুরেই জনারণ্য হয়ে উঠে বইমেলা প্রাঙ্গণ। সেসময় বই কিনতে এসে চিকিৎসক রাকিবুল হাসান জানান, তিনি উপন্যাস-গল্পের পাশাপাশি রাজনীতি ও ইতিহাসনির্ভর বই খুঁজেছেন। সাঈফুল্লাহ সাঈফ জানান, তিনি খুঁজেছেন বাংলা ভাষার গবেষণার বই।
এদিন বইমেলায় আসেন কবি কামাল চৌধুরী।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সৃজনশীল এই বইমেলা আমাদের তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে ইতিহাসের এক সেতুবন্ধন রচনা করে দেয়। একুশে বইমেলায় আজকের এই দিনে বাঙালি পাঠকের যে আবেগ, উচ্ছ্বাস দেখি, তা পৃথিবীর অন্য কোনো বইমেলায় দেখি না।”
‘বাংলা-বাঙালির টানে ছুটে আসি বারবার’
বাঙালির ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগের বীরত্বপূর্ণ গল্পে চোখ ভিজে উঠে স্প্যানিশ নাগরিক মিয়োর। স্পেনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন অধ্যয়ন নিয়ে পড়ছেন এই তরুণী।দক্ষিণ এশীয় ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে জেনেছেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রেক্ষাপট।এরপরই বাংলাদেশে আসবেন বলে মনস্থির করেন। পরে একটি বহুজাতিক সংস্থার হয়ে কাজ করার সূত্রে বাংলাদেশে আসেন প্রথমবারের মতো।
তার সঙ্গে আসা মাদাগাসকারের নাগরিক ফি জানান, সবার আগে তিনি খুব ভালো বাংলা ভাষা শিখতে চান।
“আমি জানি, এই বাংলা ভাষার সাহিত্য কত সমৃদ্ধ। এই বাংলা ভাষাই আমি সবার আগে শিখতে চাই,” বলেন ফি।
এদিন বইমেলায় কথা হয় কেনিয়ার নাগরিক ক্যাথরিন,ওসাইয়াম, নাইজেরিয়ার মসুরি ও পিটারের সঙ্গে। চিকিৎসা সংক্রান্ত একটি গবেষণার কাজে বাংলাদেশে এসেছেন তারা।
ক্যাথরিন বলেন, “একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটি আমরা বন্ধুরা মিলে পালন করি। এর ইতিহাস আরো গভীরভাবে জানতে আমি কিছু বই খুঁজছি। দুর্ভাগ্য আমার, যে বাংলাটা জানি না।”
পিটার বলেন, “অনেকবার এসেছি বাংলাদেশে।বইমেলাতেও এসেছি। এ দিনটি সত্যি অন্যরকম। আমি বাংলা ও বাঙালির টানে আবারও আসতে চাই।”