‘হতে হবে প্রতিদিনের বাঙালি’

লাল আল্পনায় সাজানো শহীদ বেদী ভরে উঠেছে রঙ বেরঙের পাপড়িতে; স্তরে স্তরে সাজানো শ্রদ্ধার্ঘ্যে ঠিকরে পড়ছে বসন্তের রোদ।

তারেক হাসান নির্ঝরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Feb 2018, 07:01 AM
Updated : 21 Feb 2018, 08:08 AM

বুধবার একুশের সকালে কালো পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা পরে চার বছরের ছোট্ট আয়ান খালি পায়ে এসেছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। প্রভাতফেরির সারিতে তার এক হাত ধরে আছে মায়ের হাত; অন্য হাতে একগুচ্ছ ফুল।

কেন এসেছে জিজ্ঞেস করতেই আয়ান বলল, শহীদ মিনারে ফুল দিতে এসেছে সে। কিন্তু ‘আজ কী দিবস’ জানতেই চাইতেই স্কলার্স স্কুলের জুনিয়র ওয়ানের এই ছাত্রের তালগোল লেগে গেল।

তার মা সুলতানা কবির বললেন, “ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে আমরা প্রভাতফেরিতে আসতাম। এখন ছেলেকে নিয়ে এসেছি। ওকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াচ্ছি। কিন্তু বাংলা ভাষার সাথে যেন দূরত্ব তৈরি না হয়, সেজন্য বাংলার চর্চাও করাই। এ ভাষার মাহাত্ম্য যেন ওর বোধের সঙ্গে মিশে থাকে তাই এখানে নিয়ে এসেছি, আগামীতেও আসব।”

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে শিক্ষার্থীদের মিছিলে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর গুলিতে প্রাণ হারান সালাম, রফিক, বরকত, শফিউরসহ নাম না জানা অনেকে। এরপর বাংলা পায় অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি। ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাঙালির এই আত্মত্যাগের দিনটি এখন আর বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়; ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে সারা বিশ্বে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও শহীদ দিবসের প্রথম প্রহরে ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের শ্রদ্ধা নিবেদনের পর শহীদ মিনারে সাধারণ মানুষের ঢল নামে। রাত ৩টা থেকে ভোর পর্যন্ত ভিড় কিছুটা কম থাকলেও সকালের আলো ফোটার পর প্রভাতফেরীর সারি শহীদ মিনার থেকে পলাশীর মোড় পেরিয়ে আজিমপুর পর্যন্ত পৌঁছে যায়।

শহরের সব প্রান্ত থেকে নানা শ্রেণি পেশার, নানা বয়সের মানুষ শোকের কালোতে সেজে শ্রদ্ধার ফুল হাতে আসতে থাকে শহীদ মিনারে। মাইকে বাজতে থাকে প্রভাতফেরির সেই গান-  আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি… আমি কি ভুলিতে পারি…।

ভোর ৬টা ১০ মিনিটে ফুল হাতে শহীদ মিনারে আসেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা।

শ্রদ্ধা নিবেদনের পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আমরা সেটা মেনে চলি। নির্বাচন কমিশন দাপ্তরিক কাজে বাংলা ভাষাই ব্যাবহার করে, শুধু বিদেশিদের সাথে যোগাযোগের জন্য ইংরেজি ব্যাবহার করে।”

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান বলেন, “আমাদের একদিনের বাঙালি হলে চলবে না। বছরে একদিন প্রভাতফেরি বা নববর্ষে একদিন পান্তা ইলিশ খেলেই চলবে না। আমাদের প্রতিদিনের বাঙালি হতে হবে।”

বেলা যত বাড়ে শহীদ মিনারে বাড়ে জনস্রোত। দীর্ঘ লাইনে ফুল আর ছোট ছোট পতাকা হাতে অপেক্ষায় থাকতে দেখা যায় বহু মানুষকে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “যারা একুশের চেতনা ধারণ করে, যারা একুশকে লালন করে তারা দুর্নীতিগ্রস্ত হতে পারে না।”

একুশের অনুষ্ঠানের মূল আয়োজক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রভাতফেরিতে শহীদ মিনার আসেন ফুল দিতে।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ঐতিহ্যিক মর্যাদা রয়েছে, একুশে ফেব্রুয়ারির আয়োজন তারই অংশ। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ অনেকেই এ আয়োজনে সহায়তা করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই গুরু দায়িত্ব পালন করতে পেরে গর্বিত।

এক প্রশ্নের জবাবে উপাচার্য বলেন, “বাংলা ভাষায় তথা যে কোনো মাতৃভাষায় যে কোনো বিজ্ঞানই চর্চা করা যায়। আমাদের উচিত হবে পরিমিত ও পরিশীলিত বাংলা ভাষা চর্চার মাধ্যমে এর বিস্তার ঘটানো। তার মানে এই না যে অন্য ভাষাকে অসম্মান করতে হবে। যে নিজের মতৃভাষাকে ভালোবাসে না সে অন্য ভাষাকেও ভালোবাসতে পারে না।”

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ফুল দিতে আসেন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক  হাছান মাহমুদ, বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন এবং দপ্তর সম্পাদক আব্দুস সোবহান গোলাপকে সঙ্গে নিয়ে।

শ্রদ্ধা নিবেদনের পর কাদের সাংবাদিকদের বলেন, “বাহান্নর শহীদদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা যে ভাষা পেয়েছি, তার পথ ধরেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা একাত্তরে দেশ স্বাধীন করেছি।

“আমি জাতিসংঘের কাছে অনুরোধ জানাই, তারা যেন ৩০ কোটি বাঙালীর বাংলা ভাষাকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।”

সাম্প্রদায়িক অশুভ শক্তিকে পরাজিত করার প্রত্যয় জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, “আজকের দিনে এটাই হচ্ছে অঙ্গীকার, একুশ এবং একাত্তরের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তুলব।”

সকাল ৯টার দিকে প্রভাতফেরির সুশৃঙ্খল লাইনে চাপ বেড়ে যায়। ছাত্রলীগ সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসেন কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের নিয়ে শহীদ বেদীতে ফুল দেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ও বিভিন্ন হল শাখা ছাত্রলীগের শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণের পর ঢাকার বিভিন্ন কলেজ ও থানা ছাত্রলীগের নেতারা ফুল দিতে আসেন।

এ সময় আদাবর থানা ছাত্রলীগ ফুল দিয়ে বেদী ত্যাগ করতে দেরি করলে প্রচণ্ড ভিড় তৈরি হয়। পরে শহীদ বেদীতে আসে শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজ ছাত্রলীগ। একপর্যায়ে ধাক্কাধাক্কি থেকে ছাত্রলীগ কর্মীদের কয়েকজনকে হাতাহাতিতেও জড়াতে দেখা যায়।