‘প্রতিষ্ঠিত লেখক-ফেইসবুক সেলিব্রেটিদের বই নিয়েই যত মাতামাতি’

প্রথম বই প্রকাশ ঘিরে অনেক স্বপ্ন আর উত্তেজনা থাকলেও তরুণ লেখকদের অনেকেরই অভিযোগ, প্রকাশকদের অবেহলার শিকার হচ্ছেন তারা।

জয়ন্ত সাহা নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Feb 2018, 06:03 PM
Updated : 15 Feb 2018, 06:36 PM

তাদের একজন বলছেন, প্রতিষ্ঠিত লেখক বা তথাকথিত ফেইসবুক সেলিব্রেটিদের নিয়েই মেতে থাকেন প্রকাশকরা।

এই বাস্তবতায় তরুণদের লেখালেখিতে উৎসাহ যোগাতে প্রকাশকদের পাশাপাশি বইমেলার আয়োজক কর্তৃপক্ষ এবং পাঠকদের মনোযোগ প্রত্যাশা করেছেন তারা।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় লেখালেখি ও বইমেলা ঘিরে নিজেদের ভাবনা তুলে ধরেছেন তরুণ লেখকরা।

আইরিন সুলতানা

 

এবার blog.bdnew24.com - তরুণ নাগরিক সাংবাদিকদের চলচ্চিত্র বিষয়ক নির্বাচিত প্রতিবেদন নিয়ে আইরিন সুলতানা সম্পাদিত ‘নগর নাব্য: চলচ্চিত্র চালচিত্র’ বইটি আসছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর পাবলিশিং লিমিটেড (বিপিএল) থেকে। এছাড়া আইরিন সুলতানার নদী রক্ষায় সচেতনতামূলক বই ’ব্রজেন দাশের খোঁজে’ প্রকাশিত হতে যাচ্ছে ’এক রঙা এক ঘুড়ি’ প্রকাশনা থেকে।

আইরিন বলেন, “প্রকাশকরা তাদের প্রকাশনা খরচ পেয়ে যাওয়ায় বই বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বাড়তি কোনো প্রচারণায় যেতে অনাগ্রহী। লেখক ও প্রকাশকের মধ্যে ‘পেশাদারিত্বের সমন্বয়হীনতাই’ তরুণ লেখকদের বিকাশে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা।

“সেদিক থেকে বলব, আমাদের বইমেলায় নাটকের বই প্রকাশে প্রকাশকদের অনীহা রয়ে গেছে।” 

শুভাশীষ সিনহা

 

শুধু লেখকের নাম বিবেচনা না করে লেখার মান বিচার করে বই প্রকাশ করলে তা তরুণ লেখকদের বিকাশে আরও সহায়ক হবে বলে মনে করেন কথাসাহিত্যে নানা উল্লেখযোগ্য পুরস্কারজয়ী লেখক শুভাশীষ সিনহা।

বাতিঘর প্রকাশনা থেকে এবারের বইমেলায় এসেছে তার দুটি কাব্য উপাখ্যান: ‘নয়নতারা’ ও ‘দহনদয়িতা’।

শুভাশীষের মতে, তরুণ লেখকরা বইমেলার প্রাণ, নতুনত্বের দিশারী। সেই লেখকদের রচনায় নতুনত্ব খুঁজতে মুখিয়ে থাকেন পাঠক। 

তরুণ লেখকের সামাজিক দায়বদ্ধতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “লেখকের প্রথম দায়বদ্ধতা তার নিজের কাছেই। সে নিজে এক সৃষ্টিশীল স্বাধীন সত্তা হিসেবে কী অনুভব করে, কী ভাবে, কী দেখে এই সব কিছু হয়ে ওঠে তার সামাজিক অস্তিত্বের অংশ।”

শাহমান মৈশান

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শাহমান মৈশানের নাটকের বই ‘কালচৌতিষা’ ও ‘ফণা এবং সুরাক’ এসেছে আদর্শ প্রকাশনী থেকে।

শাহমান বলেন, রক্ষণশীলতার ঘেরাটোপ থেকে পাঠককে উদ্ধার করে উদার ও সংস্কৃতি মনা করে তুলতে হলে বইমেলার গুরুত্ব অপরিসীম।

তরুণ লেখক হিসেবে মেলা আয়োজনের নানা অসংগতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বইমেলা কর্তৃপক্ষের মেলার স্বীকৃতি থেকে এখনও পাঠক-প্রকাশকের মেলা হয়ে উঠতে পারেনি। পাঠক নিবিষ্ট মনে বই দেখবে, জ্ঞানের পিপাসা মেটাতে লেখক-প্রকাশকের কাছে প্রতিক্রিয়া জানাবে, সেই পরিবেশ এখনও মেলায় হয়ে উঠেনি। তরুণদের বই পাঠে আরও আগ্রহী করতে স্কুল-কলেজের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করা যেত। সেটা করা হয়নি।”

প্রকাশকরা নাটকের বই প্রকাশে আগ্রহী নন জানিয়ে তিনি বলেন, “নাটকের বইয়ের বড় ভূমিকা রয়েছে। শেক্সপিয়ার থেকে শুরু করে হ্যারল্ড পিন্টার বা গ্রিক রূপকথার লেখক বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-তাদের লেখা অনেক নাটকে সামাজিক চিত্রগুলো আমরা পেয়েছি।”

খালিদ মারুফ

এ বছর বইমেলায় বাতিঘর প্রকাশনা থেকে আসছে তরুণ লেখক খালিদ মারুফের গল্প সংকলন ‘সাপ ও শাপ সংক্রান্ত গল্পাবলি’।

তিনি বলেন, “আমি মূলত মানুষের গল্পই লিখি বা লেখার চেষ্টা করি। একজন মানুষ যেহেতু বিদ্যমান সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভেতর দিয়েই কালাতিপাত করেন, ফলে চরিত্রের সাথে জায়মান ব্যবস্থার একটা বর্ণনা উঠে আসা বিচিত্র নয়, বরং কাঙ্ক্ষিত।”

মোজাফ্ফর হোসেন

 

তরুণ কথাসাহিত্যিক মোজাফ্ফর হোসেনের চতুর্থ গল্পগ্রন্থ ‘খুন হয়ে যাচ্ছে সব সাদেক’ এসেছে অন্যপ্রকাশ থেকে।

মোজাফ্ফর বলেন, “বর্তমান প্রযুক্তি ও পুঁজিনির্ভর সমাজব্যবস্থায় অন্য সকল আর্টফর্মের যে সঙ্কট বা প্রতিবন্ধকতা, ছোটগল্পেরও সেই সঙ্কট।

“প্রধান  সঙ্কট হল- পাঠকের হাতে সময় কমে যাওয়া। মানুষ এখন কাজে-অকাজে ভীষণ ব্যস্ত। একটা বায়বীয় সিস্টেম গড়ে উঠেছে মানুষকে ব্যস্ত রাখার জন্য। সেই সিস্টেমের কলকাঠি যে সব সময় মানুষের নিয়ন্ত্রণে আছে তা বলা যাবে না। ফলে পাঠক কমেছে, কমছে আরও।”

tonmoy imran

এবার বইমেলায় আদর্শ প্রকাশনী থেকে এসেছে তন্ময় ইমরানের উপন্যাস ‘মেয়েটি জিহাদে গিয়েছিল’। এছাড়া একই প্রকাশনী থেকে এসেছে তার ৩৯টি গল্পের সংকলন নিয়ে ‘মৃত্যু ও মিডিয়া এক্সপোজার’।

বইমেলায় তরুণ লেখকদের উৎসাহ দিতে বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি বইয়ের মান বিচারে সেরা পাঁচ লেখককে পুরস্কার দিতে পারে বলে মনে করেন এই লেখক। মেলা উপলক্ষে চালু হওয়া বাংলা একাডেমির ওয়েবসাইটেও তরুণ লেখকদের বইগুলোর তথ্য আরও বেশি করে দেওয়ার দাবি করেন তিনি।

রোকেয়া লিটা

 

এবার আদর্শ প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছে রোকেয়া লিটার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘পুরুষ’।

তরুণ এই লেখক অভিযোগ করলেন, তরুণ বা নতুন লেখকদের বই প্রচারের ক্ষেত্রে প্রকাশকদের মাথাব্যথা নেই। প্রতিষ্ঠিত লেখক বা তথাকথিত ফেইসবুক সেলিব্রেটিদের নিয়েই মেতে থাকেন তারা।

“তরুণদের বইয়ের প্রচার-প্রচারণায় কোনো উদ্যোগ নেই। ভাবটা এমন যেন, একজন লেখক হাজার হাজার পাঠক তৈরি করে নিয়ে এসে বই লেখা শুরু করে। আসলে তো লিখতে লিখতে হাজার হাজার পাঠক তৈরি হয়। আর এই যে পাঠক তৈরি হবে তাতে যেমন লেখকের অবদান রয়েছে, তেমনি প্রকাশকেরও অনেক দায়িত্ব রয়েছে।”

আলামিন মোহাম্মদ

 

আলামিন মোহাম্মদের কিশোর উপন্যাস ‘গান্ধী স্যার' এসেছে বাংলা প্রকাশন থেকে।

নিজের লেখালেখি নিয়ে এই তরুণ লেখক বলেন, “গড়পড়তা উপন্যাস নয়, সামাজিক অস্থিরতার পাশাপাশি দেখিয়েছি সমাধানের পথও। তরুণ লেখক হিসেবে আমি বলব, লেখায় ইতিবাচক বার্তা থাকলে পাঠক তরুণদের বইও লুফে নেবে।”

এবার বেহুলা বাংলা প্রকাশনী থেকে এসেছে গিরিশ গৈরিকের কবিতাগ্রন্থ ‘ডোম’ ।

তরুণ কবি গিরিশ গৈরিক বলেন, শিল্পের ‘স্বাধীনতা নেই’ বলে তরুণ কবি হিসেবে তিনি কবিতায় সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা বলতে পারছেন না।

শব্দশৈলী থেকে এসেছে বীথি সপ্তর্ষীর উপন্যাস ‘এক্স ক্রোমোজোম’।

তিনি বলেন, “তরুণ লেখক এবং তাদের লেখা বইয়ের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু লেখার গুণগত মান নিয়ে পাঠক-সমালোচকদের বিস্তর প্রশ্ন, টিপ্পনি, কিন্তু গঠনমূলক সমালোচনা নেই বললেই চলে। সমালোচনা কেবল সমালোচনার উদ্দেশ্যেই করা হয়। এখানে সমালোচকদের সংশোধনের কোনো উদ্দেশ্য নেই। তাই তরুণ লেখকদের অতীত লেখা বা অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে লেখার উন্নয়নের সুযোগটাও নেই।”