বইমেলায় রঙের ছোঁয়া

‘পলাশের নেশা মাখি চলেছি দুজনে বাসনার রং এ মিশি শ্যামলে... বসন্ত এসে গেছে’-ফাগুনের প্রথম প্রহরে বসন্ত বরণে নগরে যে উৎসবের সূচনা হয়েছিল, সেই উৎসবের তারুণ্যের ঢল দিনান্তে আছড়ে পড়ল বইমেলায়।

জয়ন্ত সাহা নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Feb 2018, 06:29 PM
Updated : 13 Feb 2018, 06:45 PM

পরনে হলুদ শাড়ি, তার সঙ্গে মিল রেখে হাত-কান ও গলায় গয়না, খোঁপায় বাহারি ফুল, মাথায় ফুলের মালা-উচ্ছ্বল তরুণীর এই সাজ মঙ্গলবার রং ছড়িয়েছে মেলায়।অনেকে ছিলেন জোড়ায়, একে অপরের হাত ধরে তারা ঘুরে বেড়ান বইমেলা প্রাঙ্গণজুড়ে। এরইমধ্যে পছন্দের বই কিনে নেন তারা। 

বেলা ৩টায় মেলার দুয়ার খোলার আগেই টিএসসি ও দোয়েল চত্বর মোড় থেকে জনস্রোত চলছিল গ্রন্থমেলা চত্বরে। সারি ধরতে হল এদিন, তবে তাতে ভাটা পড়েনি উৎসাহে।

পহেলা ফাল্গুন মঙ্গলবার বইমেলায় দর্শনার্থীরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

ঢাকা জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম বলেন, “বউয়ের আবদার, সকালে উৎসবে নিয়ে যেতে হবে। অফিসের ব্যস্ততায় পারিনি। এমন দিনে বইমেলায় না এলে চলে? বইমেলা থেকে বইগুলো কিনে দিয়ে ওকে নিয়ে আমি বসন্ত উৎসবে যাব।”

ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিন্দিতা সোমারা এসেছিলেন দলবেঁধে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণের রচনা সমগ্র কিনতে কিনতে অনিন্দিতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ক্লাসের ফাঁকে মেলায় আসার ফুরসত পাই না। তারপর সেমিনার, অ্যাসাইনমেন্ট তো আছেই। আজ যা একটু বের হতে পেরেছি। আজ বন্ধুরা দলবেঁধে চলে এলাম।”

শুভ্র, অনিক ও বাঁধন এসেছেন গাজীপুর থেকে। নগরে বসন্ত উৎসবগুলোতে ঢুঁ মেরে সব শেষে তারা এলেন বইমেলায়। নতুন আসা বইগুলোর দিকেই তাদের ঝোঁক।তরুণদের দলটি খুঁজছিলেন তরুণদের কথাসাহিত্য, কবিতা ও অনুবাদ।

পহেলা ফাল্গুন মঙ্গলবার বইমেলায় দর্শনার্থীরা। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর পাবলিশিংয়ের (বিপিএল) স্টলে মুস্তাফিজ মামুনের ভ্রমণবিষয়ক বই ‘বনে বেড়াই’ কিনে নিতে নিতে তরুণ পাঠক ইশতিয়াক হাসান বলেন, “বসন্ত উৎসব, ভ্যালেন্টাইন- প্রিয় মানুষকে তার পছন্দের সব বই উপহার দেবার পালা। গল্প, উপন্যাস কিনলাম অনেক, এবার ভ্রমণ বিষয়ক বইটিও কিনে নিলাম। কদিন পরেই ঘুরতে যাব, বইটা কাজে  আসবে।”

বিপিএল থেকেই প্রকাশিত হয়েছিল  ২০১৭ সালে একুশে পদকজয়ী ভাষাসংগ্রামী মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘পলাতক জীবনের বাঁকে বাঁকে’।

পহেলা ফাল্গুন মঙ্গলবার বইমেলায় দর্শনার্থীরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

পাঠক তুর্ণা আফরিন বলেন, “কমরেড তকীয়ূল্লাহ্র নিজের লেখা বই খুঁজে বেড়িয়েছি, কিন্তু কোথাও পাইনি। পরে এক বন্ধুর কাছ থেকে শুনলাম, বইটি বিপিএলে এলে পাব। এখানে এসে আরও দারুণ কিছু বই পেলাম। ‘মেলার দিকে ঘর’, ‘জীবনানন্দের খোঁজে’,  আর ‘পুনশ্চ ঢাকা’-বই তিনটি না কিনে পারলাম না। ”

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ‘সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা’ কিনে নিয়ে যাওয়ার পথে বাঁধন বলেন, “আমরা তিন বন্ধুই বেশ পড়ুয়া। ক্লাসের ফাঁকে সময় পেলে আমরা বৃথা সময় নষ্ট না করে বই পড়ি। গাজীপুরে নিজেরা একটা সাহিত্য সংসদও করেছি। নতুন লেখক কাদের বই এলো, এবার সেসব বই কিনব। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বাঙালির জ্ঞানমনীষা। তার বইটি পড়ে আমরা  নতুন কিছু জানব।”

ফাগুনের রঙে রঙিন বইমেলা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

অনুবাদে আগ্রহী ইমতিয়াজ হোসেন বিপিএল থেকে  স্যার জেমস জর্জ ফ্রেজারের ‘গোল্ডেন বাউ’র অনুবাদ গ্রন্থটি কিনে নিতে নিতে বলেন, “অনুবাদ গ্রন্থগুলোর অধিকাংশ তো পড়াই যায় না। বাক্যরীতি দেখলেই বোঝা যায়, কেমন হবে।এই বইটা সত্যি দারুণ।  কাভার, কনটেন্ট সব মিলিয়ে বইটা দারুণ।”

এদিন বইমেলায় বেচা-বিক্রিওতে সন্তুষ্ট প্রকাশকরা। বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি মাজহারুল ইসলাম বলেন, “বসন্ত উৎসব, ভালোবাসা দিবসে বরাবরেই মতো পাঠকের ঢল নেমেছে। আজ শুধু তারা ঘুরে বেড়াচ্ছেন না, ঘরে ফিরতে বইও কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।প্রিয় মানুষকে বই উপহার দেওয়ার চল কিন্তু এখনও উঠে যায়নি। অনেক পাঠক সঙ্গে আসা প্রিয় মানুষটিকে বই কিনে দিচ্ছেন। কেউ হয়ত বই পড়েন না, তাকে পড়ুয়া বানাতে বন্ধুরা চলে আসছেন বই চেনাতে। বইমেলার এই দিনটি সত্যি অন্যরকম।”

নালন্দার স্বত্বাধিকারী রেদোয়ান জুয়েল বলেন, “বসন্ত উৎসবের দিনে মেলায় সব ধরনের বই বিক্রি হয় বেশি। এদিন মেলায় সব ধরনের পাঠক আসেন। কেউ গল্প, উপন্যাস, কেউ গবেষণা, কেউবা তরুণদের লেখা খুঁজে নেন।  অন্যদিন একটু সন্ধ্যা নামলেই বিক্রি বাড়ে। আজ মেলার দুয়ার খুলতেই পাঠকের ঢল উপচে পড়ছে স্টলে। এ দৃশ্য দেখাও তো দারুণ আনন্দের।”

মেলায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও

সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরকে দেখা যায় মাঝে মধ্যেই, পহেলা ফাল্গুনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালও ছিলেন বইমেলা প্রাঙ্গণে।

বসন্তের বিকালে আসাদুজ্জামান নূর এসেছিলেন হলুদ রঙা পাঞ্জাবি গায়ে। অন্যপ্রকাশের স্টল থেকে তার বন্ধু হুমায়ূন আহমেদের ‘হিমু সমগ্র’ কিনে নিচ্ছিলেন পাঠকরা, তখন অটোগ্রাফের জন্য ঘিরে ধরেছেন প্রিয় অভিনেতাকে। কেউ এসে তুললেন সেলফি।

সংস্কৃতিমন্ত্রী তখন বলেন, “এভাবে সেলফির আবদার মেটাতে গেলে আমি বই কিনব কখন?”

সংস্কৃতিমন্ত্রীর ভক্তদের ভিড় ঠেলে অন্যপ্রকাশ স্টলে ঢুকে পড়লেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।

বাসন্তী-রঙা বসনে রাজনৈতিক সহযোদ্ধাকে দেখিয়ে তিনি বলেন, “আজ পহেলা ফাল্গুনে বইমেলায় যেন আনন্দের জোয়ার লেগেছে। সবাই দেখি বসন্তের সাজ পোশাকে মেলায় এসেছে। এই তো আমাদের বাঙালিয়ানা।  

“হাজারো মানুষ উৎসবের মধ্যে দিয়ে পহেলা ফাল্গুন উদযাপন করছে, বই ভালোবেসে তারা আজ দল বেঁধে মেলায় এসেছেন- এতেই তো প্রমাণিত হয়, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।”

এক প্রশ্নের জবাবে আসাদুজ্জামান নূর বলেন, “মেলায় কতটা মানসম্মত বই এসেছে, সেটা তো দর্শক রায় দেবে। তবে আমরা ধারণা করতে পারি, বাংলা সাহিত্যের ধারা ক্রমাগত এগিয়ে চলছে। সাহিত্যে মেধার চর্চা বাড়ছে, বাড়ছে সৃষ্টিশীলতা।”

পহেলা ফাল্গুন মঙ্গলবার বইমেলায় দর্শনার্থীরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

পহেলা ফাল্গুনে মেলাপ্রাঙ্গণ ঘোরার অভিজ্ঞতা বর্ণনায় তিনি বলেন, “বসন্ত উৎসব উদযাপন, বইমেলা তো এখন আমাদের নিয়মিত সংস্কৃতি চর্চার অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। বইমেলা ক্রমেই হয়ে উঠেছে পড়ুয়া বাঙালির এক দারুণ মিলনমেলা।”

মূল মঞ্চের আয়োজন

গ্রন্থমেলার ১৩তম দিনে মঙ্গলবার বিকালে মেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘নারীর নিরাপদ পরিসর ও পরিবেশ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন খুশি কবির। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন সুলতানা কামাল, হোসনে আরা শাহেদ, সুভাষ সিংহ রায় ও নূরুন্নাহার মুক্তা, সভাপতিত্ব করেন আয়শা খানম।

প্রাবন্ধিক বলেন, “দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন যতই হোক জনগণের অর্ধেক যখন নারী তখন নারীর উন্নয়ন না হলে আর সকল উন্নয়ন ম্লান হয়ে যাবে। যেদিন আমরা নারীকে মানুষ হিসেবে চিনতে শিখব সেদিন নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর হয়ে সমতা সৃষ্টি হবে।”

সভাপতির বক্তব্যে আয়শা খানম বলেন, “নারীর জন্য পরিসর তৈরির দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে যেখানে নারীরা নানাভাবে অবদান রেখে গেছেন। নারীর জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরির সংগ্রামে নারীর পাশাপাশি পুরুষকেও এগিয়ে আসতে হবে। সেই সাথে রাষ্ট্র, পরিবার ও সমাজে নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করে পুরুষের সাথে সমতার জন্য সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।”