ক্ষুধা-দারিদ্র্য নির্মূলে উন্নয়ন সহযোগীদের আরেকটু উদারতা চান হাসিনা

ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার সক্ষমতা অর্জনে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে এক্ষেত্রে উন্নয়ন সহযোগীদের আরেকটু উদারতা প্রত্যাশা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রিয়াজুল বাশার রোম থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Feb 2018, 03:48 PM
Updated : 13 Feb 2018, 04:39 PM

মঙ্গলবার ইতালির রাজধানীর রোমে ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্টের (আইএফএডি)  ৪১তম পরিচালনা পরিষদের সভার উদ্বোধনী অধিবেশনের মূল প্রবন্ধে এ আহ্বান জানান তিনি।

ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের জনসংখ্যা ৯০০ কোটি ছাড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে এবং এই জনসংখ্যার অর্ধেক হবে মধ্যবিত্ত শ্রেণিভুক্ত। অপরদিকে বিশ্বে চাষযোগ্য ভূমি, বনভূমি ও ব্যবহার উপযোগী পানি কমে যাবে ব্যাপকভাবে।

একইসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবের কথাও বক্তৃতায় উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ২০৮০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৬৫ সেন্টিমিটার বাড়লে বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ ফসলি জমি পানির নিচে চলে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন অর্জন করা যাবে না মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “২০৫০ সালে বিশ্বে খাদ্যের চাহিদা ২০০৬ সালের তুলনায় অন্তত ৬০ শতাংশ বাড়বে। খাদ্যপণ্যের দামও ৪৮ শতাংশের মতো বাড়বে।”

এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার পদ্ধতি কী হবে, সেই আলোচনায় বাংলাদেশের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগ বাড়ানোর আহ্বান জানান শেখ হাসিনা।

প্রায় এক দশক ধরে বাংলাদেশে ‘স্থিতিশীল সরকার’ থাকাকে সৌভাগ্যের মন্তব্য করে তিনি বলেন, আমরা প্রায় চার বছর ধরে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে আমাদের আর্থ-সামাজিক প্রবৃদ্ধির কৌশল প্রণয়ন করেছি।

“এবং তারপর গত নয় বছর ধরে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছি। আমরা খুবই সতর্কতার সঙ্গে পারিপার্শ্বিক চাহিদা ও প্রয়োজনের দিকে খেয়াল রেখে তাতে সংযোজন-বিয়োজন করেছি।”

এই পদ্ধতিতে গত নয় বছরে বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন ৯০ লাখ টন বেড়ে এখন তিন কোটি ৯০ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।

সেজন্য বিশ্বব্যাপী ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার সক্ষমতা অর্জনে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগ একটি প্রধান বিবেচ্য বিষয়। বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা ছাড়া এটা অর্জন করা যাবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস।

ক্ষুধা ও দারিদ্র্য তাড়াতে উন্নয়ন সহযোগীদের আর একটু ‘উদার’ হতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

‘ফ্রাজিলিটি টু লং টার্ম রেজিলেন্স: ইনভেস্ট ইন সাসটেইনেবল রুরাল ইকোনোমি’ প্রতিপাদ্য নিয়ে আইএফএডির এই অধিবেশন বসেছে।

বাংলাদেশের অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখতে আইএফএডি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আশা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, আইএফএডির সহায়তা ও সহযোগিতার মডেল জাতিসংঘের অন্যান্য সংস্থা থেকে অনেক ভিন্ন।

তাদের এই মডেলকে ‘আদর্শ’ অভিহিত করে ভবিষ্যতেও তা যেন এভাবে কাজ করে সে প্রত্যাশা জানান বাংলাদেশের সরকার প্রধান।

১৯৭৭ সালে জাতিসংঘের একটি বিশেষায়িত আর্থিক সংস্থা হিসেবে আইএফএডি প্রতিষ্ঠিত হয়। সংস্থাটি মূলত কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কাজ করে।

প্রতিষ্ঠার পর আইএফএডির প্রথম প্রকল্পটি ছিল বাংলাদেশে, যা ১৯৭৮ সালে নেওয়া হয়। সংস্থাটি এ পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচিতে প্রায় ৭৮২ মিলিয়ন ডলারের অনুদান এবং সহজ শর্তে ঋণ দিয়েছে।

২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতের লক্ষ্য অর্জনে আইএফএডির সহযোগিতা চান শেখ হাসিনা।

সকালে প্রধানমন্ত্রী রোমে আইএফএডির সদর দপ্তরে পৌঁছলে তাকে স্বাগত জানান সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট গিলবার্ট এফ হংবো।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হংবোর স্বাগত বক্তব্যের পর জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বক্তব্য দেন। গুতেরেস সংস্থাটির ৪০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অভিনন্দন জানান এবং উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করেন।

এরপর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর কৃষি উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর নেওয়া নানা পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে তার কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, তবে ১৯৭৫ সালে তাকে হত্যার পরের বছরগুলোতে দেশের কৃষি খাত ধারাবাহিক অবহেলার শিকার হয়েছে, যার ফলে দেশ মারাত্মক খাদ্য ঘাটতিতে পড়েছিল।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ প্রায় এক দশক ধরে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এবার আগাম বন্যার কারণে অপ্রত্যাশিতভাবে বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছিল।

এই প্রেক্ষাপটে আমদানি নীতিতে পরিবর্তনসহ নানা উদ্যোগ নিয়ে এ ঘাটতি মোকাবেলার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

শেখ হাসিনা বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির চিত্রও তুলে ধরেন।

তিনি জানান, আবাদি জমি কমার পরেও বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন ১৯৭১ সালের ১১ মিলিয়ন টন থেকে ২০১৭ সালে ৩৯ মিলিয়ন টনে পৌঁছেছে।

তার শাসনামলে খাদ্য ঘাটতি বৃদ্ধির কারণ হিসেবে কৃষকদের ভর্তুকি, কৃষি উপকরণের সহজলভ্যতা  এবং কৃষকদের সহজ শর্তে ও সুদমুক্ত ঋণ দেওয়ার কথা উল্লেখ করেন তিনি।

ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূর করা এবং পুষ্টি নিশ্চিত করাই তার সরকারের প্রধান লক্ষ্য বলে উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।

পঞ্চবার্ষিক ও প্রেক্ষিত পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলাদেশের পরিকল্পিত উন্নয়ন প্রচেষ্টার কথাও তুলে ধরেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানো, জ্বালানি সমস্যার সমাধান, কৃষি কর্মসূচি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে দারিদ্র্য কমানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

শেখ হাসিনা তার সরকারের সময় বিভিন্ন উন্নয়ন এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে স্বল্পমূল্যে খাদ্য বিতরণের কথাও তুলে ধরেন। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় দরিদ্রদের সহায়তার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।

তার সরকারের সময় নেয়া একটি বাড়ি ও একটি খামার প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের কথাও উল্লেখ করেন তিনি।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর আইএফএডির প্রেসিডেন্টের দেওয়া মধ্যাহ্নভোজে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর আইএফআইডির প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকের ঋণ চুক্তি অনুষ্ঠানে যোগ দেন।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী ও কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী আইএফআইডি সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন।

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রোমে প্রবাসী বাংলাদেশিদের এক সংবর্ধনায় দেবেন প্রধানমন্ত্রী। সফর শেষে ১৬ ফেব্রুয়ারি তার দেশে ফেরার কথা রয়েছে।