‘রঙ যেন মোর মর্মে লাগে’

উত্তুরে হিমেল হাওয়া থেমে গেল; দখিনা বাতাসে ঘুচে গেল পাতা ঝরার রিক্ত-বেদনা, নগরে এল বসন্ত।

জয়ন্ত সাহাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Feb 2018, 08:04 AM
Updated : 13 Feb 2018, 09:53 AM

ফাগুনের প্রথম প্রহরে ষড়ঋতুর শেষ ঋতুটিকে বরণ করে নিতে কত আয়োজন রঙ! হাজারো প্রাণের কল্লোলে নগর এখন সবুজ-শ্যামল প্রকৃতির জয়গানে মুখর।

বাসন্তী রাঙা বসন আর ফুলের শোভায় সেজে মানুষ ছুটছে উৎসবের আঙ্গিনায়। ফাল্গুনের প্রথম দিনে বসন্তের দোলা তাদের হৃদয়েও।

প্রতি বছরের মত এবারও রাজধানীতে জাতীয় বসন্ত উদযাপন পরিষৎ আয়োজন করেছে বসন্ত উৎসবের। মঙ্গলবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় ছিল এ আয়োজন।

সকাল ৭টায় দীপন সরকারের গিটারে রাগ বসন্ত বিহারের মূর্চ্ছনায় শুরু হয় উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। গান, কবিতা আর সম্মেলক নৃত্যে শুরু হয় নাগরিক বসন্ত উদযাপন।

দীপন সরকারের পর পারভেজ-সুশান্ত পরিবেশন করেন রাগ আহির ভৈরব। প্রভাতী রাগের আলাপ, গৎ- এর সঙ্গে বাদ্যযন্ত্রের ধুনে ভোরের উৎসব পায় অন্য মাত্রা। ততক্ষণে বকুলতলার আনাচেকানাচে বসন্তের স্তুতি-গানে মেতে উঠেছেন নগরবাসী।

কণ্ঠে কণ্ঠে তখন সেই গান- ‘বসন্ত বাতাসে সই গো, বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে’।

এরপর ধ্রুপদী নৃত্য নিয়ে মঞ্চে আসেন প্রিয়াঙ্কা প্যারিস গোমেজ। বসন্তের কবিতা আবৃত্তি করেন সৈয়দ হাসান ইমাম ও ভাস্বর বন্দোপাধ্যায়। নার্গিস চৌধুরী পরিবেশন করেন ‘আমি পথভোলা পথিক এসেছি’ গানটি। রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী লাইসা আহমেদ লিসা শোনান দুটি গান।

সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী সম্মেলক কণ্ঠে গেয়ে শোনান অতুল প্রসাদের ‘আয়রে বসন্ত’ গানটি। ‘দোল ফাগুনের দোল লেগেছে’ গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন শর্মিলা বন্দোপাধ্যায় ও তার দল নৃত্যনন্দন।

পরে সামিনা হোসেন প্রেমা তার দল ভাবনাকে নিয়ে ‘আজি দখিন দুয়ার’ গানের সঙ্গে মঞ্চে পরিবেশন করেন একটি সম্মেলক নৃত্য। মণিপুরি নৃত্য নিয়ে মঞ্চে আসেন তামান্না রহমান ও তার দল নৃত্যম। গৌড়ীয় নৃত্য পরিবেশন করেন র‌্যাচেল প্রিয়াংকা প্যারিস।

সাংস্কৃতিক পর্বের ফাঁকে সৈয়দ হাসান ইমাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতি বছরই তো আমরা এ নগরে বসন্ত উদযাপন করি। আমরা স্মৃতি রোমান্থন করি, কোথায় গেল সেই ফুলেল শৈশব আমাদের। ইট কাঠের শহরে বসে আমরা হা-পিত্যেষ করি মাটির সোঁদা ঘ্রাণের জন্য। উৎসবগুলো যে আমাদের মাটির কাছে ফিরে যাওয়ার আকুতি আরও বাড়িয়ে তুলে। তাই তো আজ রঙের উৎসবে সামিল হতে ছুটে আসছে নগরবাসী।”

বসন্ত উৎসবে নিজেকে রাঙিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি প্রকৃতিকে রক্ষার শপথও ধ্বনিত হল তার কণ্ঠে।

“জীবজন্তু, গাছপালা সবকিছু নিয়েই তো আমাদের এই শ্স্য-শ্যামল বসুন্ধরা। এই পৃথিবীতে সকলের বেঁচে থাকার অধিকার। বসন্ত উৎসব উদযাপনের পাশাপাশি আজ আমরা প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার শপথ নেই।”

উদীচীর সহ-সভাপতি সংগীতা ইমাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আজ খুব করে চাইব যেন রঙ যেন সকলের মর্মে লাগে। প্রাণ প্রকৃতিকে রক্ষার শপথ নিয়ে আমরা চাইবো সর্বস্তরে যেন বসন্তের রঙ লাগে, রঙ লাগুক আমাদের নাগরিক  চেতনায়।”

আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দোপাধ্যায় বলেন, “ঋতু উৎসবের মধ্যে বসন্ত উৎসবের মর্ম একেবারেই আলাদা। বছরের শেষ ভাগের এই উৎসবের মধ্য দিয়ে আমরা নতুন এক বাংলা বর্ষ উদযাপনের অপেক্ষায় থাকি। নগরে বসন্ত উদযাপন প্রতি বছর নতুন মাত্রা পায় তরুণের কোলাহলে। তাদের কণ্ঠে যখন মাটির কাছে ফেরার গান শুনি, তখন সত্যি মনে হয়, এই তো উৎসবের সার্থকতা।”

ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমেদ লিসা বলেন, “বসন্ত উৎসব হয়ত অন্য অনেক দেশেই উদযাপিত হবে। কিন্তু ষড়ঋতু সবখানে এত স্পষ্ট নয়। ঋতু বৈচিত্র্যের দেশে ঋতু উৎসবে এসে আমরা শপথ নেই- আমরা প্রকৃতি রক্ষা করে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলব। সম্প্রীতির বন্ধনে একে অপরকে বাঁধব।”

উৎসব উদযাপন পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট বলেন, বসন্ত উৎসব উদযাপনের প্রধান লক্ষ্য হল নগরবাসীর মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন যেন আরও দৃঢ় হয়।

“সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি আমরা বাঙালি সংস্কৃতিতে তরুণদের উদ্বুদ্ধ করব, তারা যেন শেকড়সন্ধানী হয়ে ওঠে।”

দুই মেয়ে সুধা ও ফিজাকে নিয়ে ফাগুনের প্রথম সকালে বন্দ উৎসবে এসেছিলেন আফরিদা মিনি। তার দুই মেয়েই উৎসবে নৃত্য পরিবেশন করেছে।

“যান্ত্রিক জীবনে হা-পিত্যেষের অন্ত নেই। সেখানে এই বসন্ত উৎসব আনন্দ বারতা নিয়ে আসে। আমরা ছেলেমেয়েদের জানাতে পারি, বাংলাদেশ কত সমৃদ্ধ।”

তাবাসসুম সুলতানা বলেন, “নিজেকে রাঙিয়ে নেওয়ার এ উৎসবে এসে প্রতিবারই নতুন সব বন্ধু খুঁজে পাই। আত্মকেন্দ্রিক এই শহরে নতুন বন্ধুই বা কজনে হতে চায়!”

উৎসবের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ফাঁকে ছিল রাখি বন্ধন পর্ব। রাখি পড়িয়ে নতুন বন্ধু গড়ে নিতে উৎসব মঞ্চে উঠে আসে তরুণের দল।

বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক তরুণের হাতে রাখি পড়িয়ে এক তরুণী বললেন, বন্ধুরা মিলে এ নগরকে ফুলে-সবুজে আরও সমৃদ্ধ করে তুলতে চান তিনি।

উৎসবের মঞ্চে সংগীত পরিবেশন করেন মিতা হক, প্রিয়াংকা গোপ, বুলবুল ইসলাম, বিমান চন্দ্র মিস্ত্রি। সমবেত সংগীত পরিবেশন করেন সুরতীর্থ, নজরুল সংগীত শিল্পী সংস্থার শিল্পীরা।

মানজার চৌধুরী সুইট জানান, সকালের পর্বটির পরে বিকাল সাড়ে ৩টায় চারুকলায় বকুলতলায় উৎসবের দ্বিতীয় পর্বেও নানা পরিবেশনা থাকবে।

এছাড়া লক্ষ্মীবাজারের বাহাদুর শাহ পার্ক, ধানমণ্ডির রবীন্দ্র সরোবর, উত্তরার রবীন্দ্র সরণি মুক্তমঞ্চে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত উৎসব চলবে।