নীতিমালার খাঁড়ায় ‘জৌলুস হারাচ্ছে’ লিটল ম্যাগ চত্বর

লিটল ম্যাগ চত্বরের স্টলগুলোতে লিটল ম্যাগ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত বই-ম্যাগাজিন বিক্রি নিষিদ্ধ করায় বইমেলার জমজমাট এই চত্বর ‘প্রাণ হারিয়েছে’ বলে অভিযোগ করেছেন লিটল-ম্যাগ প্রকাশকরা।

জয়ন্ত সাহাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Feb 2018, 07:47 PM
Updated : 11 Feb 2018, 07:47 PM

তারা বলছেন, তরুণ লেখক, পাঠক ও প্রকাশকদের আড্ডায় বইমেলার প্রতি সন্ধ্যায় এই চত্বর গমগম করত, কিন্তু এখন আর তা হচ্ছে না। নতুন বই না পাওয়ায় পাঠকরাও আর তেমন আসছেন না।

লিটল ম্যাগ ধ্রুপদীর সাঈদা নাঈম, ম-প্রকাশনীর মাসুম বিল্লাহ, নৃ’র ইব্রাহীম খলিল, শব্দগ্রন্থের রাজিউর রহমান, প্রতিবেশীর অনুকূল রোজারিও, বিবর্তনের আরমিন রাসেল, খননের রঘু অভিজিৎ রায় সবাই এই অভিযোগ করেছেন।

বইমেলার নীতিমালার ১৪.২ ধারায় বলা হয়েছে, এবার বইমেলায় লিটল ম্যাগ চত্বরে বরাদ্দ পাওয়া স্টলে কেবল লিটল ম্যাগই বিক্রি করা যাবে, লিটল ম্যাগ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত কোনো বই বা ম্যাগাজিন বিক্রি করা যাবে না।

এই সিদ্ধান্তকে ‘হঠকারী’ আখ্যায়িত করেছেন সাঈদা নাঈম।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “লিটল ম্যাগ চত্বরে যখন নিজেদের বইগুলোই আমরা সাজিয়ে রাখছি, বাংলা একাডেমি নীতিমালার দোহাই দিয়ে আমাদের বইগুলো নামিয়ে দিচ্ছে। আমরা যখন তরুণদের প্রতিষ্ঠা করতে লড়াই করছি, তখন বাংলা একাডেমির এই সিদ্ধান্ত।”

তিনি বলেন, “গল্প, সাহিত্যের বাইরে এসে লিটল ম্যাগ চত্বরের পাঠকরা লিটল ম্যাগ কিনতে চান না। এমনকি ফ্রি তে দিলেও তারা সেই লিটল ম্যাগ ফেলে রেখে যাবে, লিটল ম্যাগ প্রকাশনীগুলোর গল্প, কবিতা ও উপন্যাসের দিকে তাদের নজর। সেক্ষেত্রে এ নীতিমালা বলবৎ থাকলে তরুণরা বই প্রকাশে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে।”

ধ্রুপদী প্রকাশনী থেকে এবারের বইমেলায় তার কাব্যগ্রন্থ ‘মেঘবালক’, গল্পগ্রন্থ ‘রোদগুলো জীবনের পারে’, সম্পাদনা গ্রন্থ ‘সাহিত্যে নারীর সাফল্য’, উপন্যাস ‘মেহেরুন্নেসা’ প্রকাশিত হয়েছে বলে জানান তিনি।

আরেক লিটল ম্যাগ প্রকাশক মাসুম বিল্লাহ বলেন, “পুরো মেলা যদি এক জায়গায় হত, তবে ভালো হত। তারকা লেখকদের বই আসছে প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনা থেকে, সেগুলো আবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রান্তে। সেখানে ঘোরাফেরা শেষ করে ওখান থেকে বই কিনে চলে যাচ্ছে পাঠক। এ প্রান্তে তো কেউ আসছেন না।”

মেলায় ‘ম’ প্রকাশনী থেকে এসেছে তার গল্পগ্রন্থ ‘প্রেম অথবা ঘুমের গল্প’।

তরুণ এই লেখক বলেন, “যখন নিজেরা গাটের পয়সা খরচ করে ছোট প্রকাশনা থেকে বই বের করছি আমরা, সেই বইগুলো আমরা পাঠকের কাছে পৌঁছাব কোন উপায়ে? লিটল ম্যাগকে আলাদা একটি স্থানে ঠাঁই দেওয়া হল। লিটল ম্যাগকে আলাদা করার কি মানে? লিটল ম্যাগ কি মূলধারার সাহিত্যের অংশ নয়?”

নৃ’র প্রকাশক ইব্রাহীম খলিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই চত্বরটি নান্দনিক করতে কোনো উদ্যোগ নেই বাংলা একাডেমির। এখানে এক সময় জনপ্রিয় লেখকরা আসতেন। তারাও আসছেন না। জৌলুস হারিয়ে ফেলছে লিটল ম্যাগ চত্বর।”

স্বপ্নিলের স্বত্বাধিকারী সাইফুল সাইফও একই অভিযোগ করেন: “লিটল ম্যাগ চত্বর প্রাণ হারাচ্ছে। অবস্থা দেখুন, এ চত্বর বড় অবহেলিত। এই এতটুকু জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। স্টলগুলোর পরিসর আরও বড় হলে ভালো হত।”

সাইফ বলেন, “ছোট প্রকাশনী হলেও আমরা যার তার বই ছেপে দেই না। আমরা অবশ্যই সাহিত্যের গুণ বিচার করে তবেই বই প্রকাশ করি।”

অনেক লিটল ম্যাগ প্রকাশকের প্রতি অসন্তোষ জানিয়ে খননের রঘু অভিজিৎ রায় বলেন, “সাহিত্যের বাজার বিকাশের প্রচলিত ধ্যানধারণার বিপরীতে গিয়ে কর্পোরেট সংস্কৃতির বিরোধিতাই ছিল লিটল ম্যাগ আন্দোলনের লক্ষ্য। কিন্তু এখন অধিকাংশ লিটল ম্যাগই ক্ষমতাসীনদের কথা বলে, কর্পোরেট সংস্কৃতির দালালি করে। মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হওয়াতেই লিটল ম্যাগের এই দুর্দশা। “

তিনি বলেন, “শুধু তো বই বের করলে হবে না। নতুন লেখক যেমন আসবে, তেমন তাদের তো নতুন চিন্তাও থাকা চাই। প্রচলিত গতানুগতিক ধারা ভাঙ্গতে চায়, এমন লেখা কোথায়?”

লিটল ম্যাগ চত্বরে বই কিনতে আসা সুরাইয়া আক্তার বলেন, “নতুন কবি, লেখকদের বইয়ের খোঁজে আমি সব সময় লিটল ম্যাগ চত্বরে আসি। বড় সাহিত্যিকদের বই তো অবশ্যই কিনি, নতুন যারা লিখছেন তাদের বইও কিনি। তাদের কবিতার বই সব সময় পছন্দের আমার।লিটল ম্যাগ কিনে আমি কী করব!”

লিটল ম্যাগ প্রকাশকদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান গ্রন্থমেলা পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক জালাল আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। পরে জালাল আহমেদকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

মূল মঞ্চের আয়োজন

রোববার বিকালে গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় রুশ বিপ্লবের শতবার্ষিকী শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইমতিয়ার শামীম। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ডা. সারওয়ার আলী ও অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক পবিত্র সরকার।

পবিত্র সরকার বলেন, “সে বিপ্লব শুধু রুশ দেশেই আবদ্ধ থাকেনি, সমগ্র পৃথিবীর দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছিল। আত্মদানের মাধ্যমে স্বপ্নপূরণের অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছিল রুশ বিপ্লব।

“সাহিত্য জগতেও বিপ্লবের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছিল রুশ বিপ্লব এবং ধ্বনিত করেছিল শোষণমুক্তির কথা, মানুষের অধিকার আদায়ের কথা, নারীমুক্তির কথা।”

নতুন বই

বাংলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গ্রন্থমেলার ১১তম দিনে এসেছে ১০২টি নতুন বই। এগুলোর মধ্যে গল্প ১৬টি, উপন্যাস-১২টি, প্রবন্ধ-৫, কবিতা -৩৭, গবেষণা-১টি, ছড়া-২, শিশুসাহিত্য-১, জীবনী-২, মুক্তিযুদ্ধ-২, বিজ্ঞান-১, ভ্রমণ-২, ইতিহাস-৩, রাজনীতি-১, রম্য-৩, অন্যান্য বিষয়ে ১৪টি নতুন বই এসেছে।