জিয়া ট্রাস্টের এতিমখানায় নেই কোনো এতিম

যে ট্রাস্টের জন্য বিদেশ থেকে আসা অর্থ আত্মসাতের দায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে কারাগারে যেতে হয়েছে, সেই ট্রাস্ট পরিচালিত এতিমখানায় এখনও এতিমদের স্থান হয়নি।

জিয়া শাহীনও অলীপ ঘটকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Feb 2018, 12:32 PM
Updated : 8 Feb 2018, 12:34 PM

জিয়াউর রহমানের জন্মস্থান বগুড়ার গাবতলীতে জিয়া ট্রাস্টের এতিমখানার জমিতে কোনো ভবনই তৈরি হয়নি; সেখানে ট্রাস্টের ৯ বিঘা জমি পতিত পড়ে আছে।   

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এই মামলায় রায়ের আগে এতিমখানার এই চিত্র দেখা যায়।

বগুড়া শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে গাবতলী সদর ইউনিয়নের তরফসরতাজ গ্রামে দাঁড়াইল বাজারের পাশে  সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দক্ষিণ পাশের গা ঘেঁষে সাড়ে ৯ বিঘা জমিতে ঝুলছে জিয়া অরফানেজ টাস্ট্রের সাইনবোর্ড।

ওই জমির কোনোটি পতিত পড়ে আছে, আবার কোনোটিতে সরিষা লাগানো হয়েছে। কোনোটিতে ইরি-বোরোর বীজতলা; কিছু জমিতে চলছে ইরি-বোরো চাষের প্রস্তুতি।

সেখানে উৎসুক জনতার ফিসফাস চললেও কথা বলতে চাইলে অনেকেই এড়িয়ে যান।

ট্রাস্টের কাছে জমি বিক্রি করেছেন, এমন কয়েকজন বলেন, তাদের ন্যায্য দাম দেওয়া হয়নি।

জমিদাতা অবসরপ্রাপ্ত মাদ্রাসা শিক্ষক মো. মুসা আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “৪৭ হাজার টাকা দিয়ে ৩২ শতাংশ জায়গা কিনেছিলাম। সেই জায়গা জোর করে নিয়ে প্রতি শতকের দাম ১ হাজার করে দিয়েছে।”

বগুড়ায় জিয়া এতিমখানা ট্রাস্টের জমি

বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং থানার এক এসআই জমি বিক্রির জন্য চাপ দিতে এসেছিলেন বলে দাবি করেন মুসা।

“আমি বলেছিলাম, জোর করে জমি নেওয়া ভালো হবে না। তারা আমাকে বলেছিল, ‘জমি না দিলে জেলের শিক গুণতে হবে’। ভয়েই জমি দিয়েছি।”

মুসা বলেন, “জোর করে জমি নেওয়ার পর কথা ছিল যতদিন এতিমখানা না হবে, ততদিন জমিদাতারা ওই জমি ভোগ করবে। কিন্তু তারেক রহমান দেশের বাইরে যাওয়ার পরে বিএনপি নেতারা ওই সব জমি লিজ দিয়ে টাকা খাচ্ছে। তারেক রহমান থাকা অবস্থায় আমরা ওই জমি ভোগ করতাম।”

আরেক জমিদাতা এক হিন্দু নারী জমির ন্যায্য দাম না পাওয়ার কথা জানিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভাই আমরা হিন্দু মানুষ, বেশি কিছু বলতে পারব না। আমার যেন কোনো সমস্যা না হয়।”

আরেক জমি বিক্রেতা নিজাম উদ্দিন মাস্টার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, যারা জমি দেবে তাদের সন্তানদের এতিমখানায় চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বিএনপি নেতারা। তবে তার আর বাস্তবায়ন ঘটেনি।

দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় অভিযোগ করা হয়, ১৯৯১-৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে আত্মসাতের উদ্দেশ্যে দুই ছেলে ও জিয়ার ভাগ্নের নামে জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট খুলে বিদেশ থেকে আসা ২ কোটি টাকা ওই ট্রাস্টে স্থানান্তর করেন।

বগুড়ায় জিয়া এতিমখানা ট্রাস্টের জমি

এজাহারে বলা হয়, এরপর বগুড়ার দাঁড়াইল মৌজায় ২ লাখ ৭৭ হাজার টাকা দিয়ে জিয়া এতিমখানা  ট্রাস্টের নামে ২.৭৯ একর জমি কেনা হয়। অবশিষ্ট টাকা কোনো অডিট না করিয়ে নামসর্বস্ব ট্রাস্টের হিসাবে অব্যয়িত রাখা হয়।

“উল্লিখিত অব্যয়িত অর্থের স্থিতি সুদাসলে ২০০৬ সালে দাঁড়ায় ৩ কোটি ৩৭ লাখ ৯ হাজার ৭৫৭ টাকা। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে তার পরিবারের সদস্য ও বিভিন্ন ব্যক্তির নামে এফডিআর খুলে তা নগদায়ন করা হয়। যার মাধ্যমে তিনি এবং তার পরিবারের সদস্যদের সহায়তায় অর্থ আত্মসাতের প্রক্রিয়া শুরু হয়।”

খালেদা জিয়া দাবি করে আসছিলেন, তিনি কোনো দুর্নীতি করেননি, ট্রাস্টের কোনো অর্থ আত্মসাতও হয়নি। সব অর্থ ব্যাংকে রয়েছে।

তবে আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারায়, ক্ষমতায় থেকে অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে ‘অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গের’ কারণে খালেদা জিয়াকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

তারেক ও জিয়ার ভাগ্নে মমিনুর রহমানসহ অন্য আসামিদের ১০ বছর সাজা হলেও ‘বয়স ও সামাজিক মর্যাদা’ বিবেচনা করে খালেদা জিয়াকে ৫ বছর কারাদণ্ড দেওয়ার কথা বলেছেন বিচারক।

রায় শুনতে আদালতের পথে খালেদা জিয়া

জিয়া অরফ্যানেজ ট্রাস্টের এই শুরুটা জিয়া মেমোরিয়াল অরফ্যানেজ ট্রাস্ট দিয়ে, যা গড়ে তুলেছিলেন বিএনপির সাবেক মহাসচিব এবং সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান।

মোস্তাফিজ পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালেই কুয়েতের আমিরের ওই অর্থ এসেছিল বাংলাদেশি এতিমদের জন্য, যা পরে জিয়া অরফ্যানেজ ট্রাস্টে স্থানান্তর হয়েছিল।

১৯৯৪ সালের ২৩ জুন বাগেরহাট শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরে বেমরতা ইউনিয়নের ফতেপুর গ্রামে ৩ দশমিক ৯০ একর জমির উপর জিয়া মেমোরিয়াল অরফারেজ ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেন মোস্তাফিজ।

এই ট্রাস্টের একতলা ও দ্বিতলসহ মোট পাঁচটি ভবন রয়েছে। এই ভবনে প্রশাসনিক কার্যালয়, পাঠদান কক্ষ, শিক্ষার্থীদের আবাসিক হোস্টেল, প্রশিক্ষণ কক্ষ ও রান্নাঘর রয়েছে। এরমধ্যে একটি ভবন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ায় তা পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।

জিয়া মেমোরিয়াল অরফ্যানেজ ট্রাস্টের অধ্যক্ষ আফতাব আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বর্তমানে তিনিসহ মোট আটজন কর্মচারী রয়েছে। বাবা-হারা দুস্থ অসহায় দুই শিশু ছাড়া বর্তমানে এখানে কেউ থাকে না।

গত দুই যুগে এখানে ২৬২ জন এতিম, দুস্থ অসহায়কে বিভিন্ন কারিগরি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। চার থেকে পাঁচ বছর বয়সী ২২ জন শিশু প্রাক প্রাথমিক এবং আরবি শিক্ষা নিচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানে। এছাড়া ১৫ জন নারীকে দর্জি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

আফতাব জানান, মোস্তাফিজুর রহমান মারা যাওয়ার পর তার ছেলে রিয়াজুল ইসলাম এই প্রতিষ্ঠানটি চালিয়ে যাচ্ছেন।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মনোয়ার হোসেন টগর বলেন, এই প্রতিষ্ঠানের কোনো তথ্য সমাজসেবা অধিদপ্তর বা জেলা প্রশাসনের কাছে নেই।

এবিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বাগেরহাট সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক কানিজ ফাতেমা মোস্তফা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জিয়া মেমোরিয়াল অরফ্যানেজ ট্রাস্টের কার্যক্রম সম্পর্কে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই।”