রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুতে আরও দেরি

রোহিঙ্গা পরিবারের তালিকা তৈরি ও যাচাইয়ের কাজ শেষ না হওয়ায় প্রাথমিক লক্ষ্য অনুযায়ী মঙ্গলবার থেকে তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো শুরু করা যাচ্ছে না।

কক্সবাজার প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Jan 2018, 12:38 PM
Updated : 22 Jan 2018, 01:26 PM

শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম সোমবার কক্সবাজারে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কিছুটা সময় লাগবে। দুই দেশের প্রস্তুতিমূলক অনেক কাজ রয়েছে, যেগুলো মূল কাজ (প্রত্যাবাসন) শুরুর আগে আমাদের শুরু করতে হবে।”

এদিকে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে প্রত্যাবাসন নিয়ে উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছে। ফিরে যাওয়ার আগে মিয়ানমার সরকারের কাছ থেকে নাগরিকত্বের অধিকার, ভূমি ফিরে পাওয়া এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চেয়ে সোমবারও রোহিঙ্গাদের একটি দল বিক্ষোভ করেছে বলে খবর দিয়েছে রয়টার্স।

গতবছর ২৫ অগাস্ট রাখাইনে নতুন করে সেনা অভিযান শুরুর পর এ পর্যন্ত ছয় লাখ ৮৮ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের অধিকাংশই আছে কক্সবাজারের কুতুপালং ক্যাম্পে।

তাদের ফেরত পাঠাতে গত ২৩ নভেম্বর মিয়ানমার ও বাংলাদেশ যে সম্মতিপত্রে সই করেছিল, সেখানে দুই মাসের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করার লক্ষ্য ঠিক করেছিল দুই দেশ। সেই দুই মাস সময় শেষ হচ্ছে মঙ্গলবার। 

ওই সম্মতিপত্রের ভিত্তিতে দুই দেশ গত ১৯ ডিসেম্বর যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করে এবং ১৬ জানুয়ারি ওই গ্রুপের প্রথম বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিভিন্ন বিষয় ঠিক করে ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ স্বাক্ষরিত হয়।

রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাইয়ের জন্য একটি ফরমও চূড়ান্ত করা হয় জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে। ঠিক হয়, পরিচয় যাচাই ও প্রত্যাবাসনের কাজটি করা হবে প্রতিটি পরিবারকে একটি ইউনিট ধরে।

চুক্তিতে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য সীমান্তে পাঁচটি ট্রানজিট ক্যাম্প খুলবে বাংলাদেশ। সেখান থেকে তাদের নিয়ে প্রাথমিকভাবে রাখা হবে মিয়ানমারের দুটি ক্যাম্পে। পরে সাময়িকভাবে তাদের থাকার ব্যবস্থা হবে হ্লা পো কুংয়ের অস্থায়ী ক্যাম্পে। পাশাপাশি ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ভিটামাটিতে দ্রুততার সঙ্গে বাড়িঘর পুননির্মাণের ব্যবস্থা নেবে মিয়ানমার।

এ কাজগুলো এখনও শেষ না হওয়ায় এখনই প্রত্যাবাসন শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না বলেন জানান শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম।   

তবে প্রত্যাবাসন শুরুর নতুন কোনো দিন তারিখের কথা তিনি বলেননি।

আবুল কালাম বলেন, “আমরা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার মধ্যেই আছি। কাজ চলমান আছে। প্রস্তুতি সম্পন্ন হলেই আমরা মূল প্রত্যাবাসন, তাদের ফেরত পাঠানোর কাজটি শুরু করতে পারব বলে আশা করছি।”

পুরো কাজটিকে তিন ভাগে দেখার কথা জানিয়ে প্রত্যাবাসন কমিশনার বলেন, প্রথম পর্যায়ের কাজ হল পদ্ধতিগত বিষয় ঠিক করা। দ্বিতীয়ত ভৌত ও কাঠামোগত ব্যবস্থা তৈরি করা। তৃতীয় পর্যায়ে প্রত্যাবাসান শুরু করা।

“প্রথম ধাপটি আমরা ভালোভাবেই শুরু করেছি বলা যায়। আমরা এখন দ্বিতীয় পর্যায়ে আছি। ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্টের আলোকে আমরা প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছি। পাঁচটি ট্রানজিট ক্যাম্প করতে হবে, সেগুলোর স্থান নির্বাচন করেছি। পরিবারভিত্তিক তালিকা প্রণয়নের কাজও চলছে।”

আবুল কালাম বলেন, চুক্তিতে ঠিক হয়েছে এই প্রত্যাবাসন হবে নিরাপদ ও স্বেচ্ছামূলক। অর্থাৎ, রোহিঙ্গাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ফেরত পাঠানো যাবে না। সুতরাং মিয়ানমারে গিয়ে তারা কী অবস্থা পাবেন, সে বিষয়েও আশ্রয় শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের ধারণা দিতে হবে। সচেতনতা তৈরির এ কাজটি দ্বিতীয় পর্যায়েই করতে হবে। 

“প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা পরিবার বাংলাদেশে আছে, তার মধে দেড় লাখের বেশি পরিবার এসেছে ২৫ অগাস্টের পর। চুক্তি অনুযায়ী এবার শুধু তাদেরই ফেরত পাঠানো হবে। তাদের সবাইকেই আমরা ফেরত পাঠাতে চাই। সে অনুযায়ী আমরা তালিকা তৈরি করছি। পুরো তালিকা হয়ে গেলে আমরা গ্রাম ভিত্তিতে তাদের ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করব। যাতে তারা নিজেদের মধ্যে সংঘবদ্ধ থাকতে পারে। প্রত্যাবর্তন করেও যেন তারা আস্থা নিয়ে সেখানে থাকতে পারে।”

বাংলাদেশ সরকারের এই কর্মকর্তা বলেন,মিয়ানমার থেকে যারাই এসেছে তাদের সবাইকেই তালিকায় আনা হবে। ওই তালিকা মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। এরপর মিয়ানমার তাদের তৈরি ভেরিফিকেশন ফরম অনুযায়ী তালিকার ব্যাপারে যাচাই-বাছাই করবে।

“পাঠানো তালিকা চূড়ান্ত করে আমাদের পাঠানোর পর জানা যাবে তারা কতজন রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে ইচ্ছুক। এটি পাওয়ার পর রোহিঙ্গাদের মধ্যে স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের বিষয়টি যাচাই করতে মাঠ পর্যায়ে কাজ করা হবে।”

তিনি জানান, বাংলাদেশ সপ্তাহে ১৫ হাজার করে রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু মিয়ানমার প্রথম দিকে সপ্তাহে দেড় হাজার করে ফেরত নিতে সম্মত হয়েছে।

“প্রথম দিকে প্রত্যাবাসনটা এভাবেই শুরু হবে। তবে মিয়ানমার এও বলেছে, সময়ের সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে এ সংখ্যাটা পুনঃনির্ধারণ করা হবে। এতে তারা সম্মত আছে।”

 

ওই চুক্তির ভিত্তিতে মিয়ানমারেও প্রস্তুতি চলার খবর দেশটির পত্রিকায় এসেছে।

শনিবার গ্লোবাল নিউ লাইট অফ মিয়ানমারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রাখাইন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ইউ নি পু নেতৃত্বে মিয়ানমার সরকারের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী নাখুয়ার হ্লা পোয়ে কুংয়ে এবং তাউয়ং পিও লেতভে ক্যাম্প পরিদর্শন করে থাকার ঘর, স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা পুরোপুরি প্রস্তুত করার নির্দেশ দিয়েছেন।

মংডু শহরের কাছে তাউয়ং পিও লেতভে ক্যাম্প পরিদর্শনের একটি ছবিও প্রকাশ করা হয়েছে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় সংবাদপত্রে। কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা প্রাঙ্গণে কাঠের তৈরি বড় ঘর দেখা গেছে ওই ছবিতে।

মিয়ানমারের ত্রাণ, পুনর্বাসন ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মহা পরিচালক কো কো নাইং সোমবার রয়টার্সকে বলেন, “তারা ফিরে এলে আমরা তাদের গ্রহণ করতে প্রস্তুত। আমাদের দিক থেকে প্রস্তুতির কাজ শেষ।”

বাংলাদেশের তরফ থেকে প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হওয়ার বিষয়ে কিছু জানানো হয়েছে কি না- এ প্রশ্নে কোনো মন্তব্য করেননি মিয়ানমারের এই কর্মকর্তা। 

এদিকে ফিরে যাওয়ার শর্ত তুলে ধরে সোমবারও বিক্ষোভ করার চেষ্টা করেছেন একদল রোহিঙ্গা। 

তারা বলছেন, মিয়ানমারের নাগরিকত্বের অধিকার; নিজেদের ভূমি, বাড়িঘর মসজিদ ও স্কুল ফিরে পাওয়া, সেনা অভিযানের নামে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটের বিচার; সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নামে গ্রেপ্তার রোহিঙ্গাদের মুক্তি এবং মিয়ানমারে ফেরার পর নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না পেলে তারা ফিরে যাবেন না।

রয়টার্স লিখেছে, ক্যাম্পের কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা সোমবার সকালে পালংখালি ক্যাম্পের কাছে লাউড স্পিকার ও নিজেদের দাবি সম্বলিত ব্যানার নিয়ে বিক্ষোভ করার চেষ্টা করেন। পরে সেনা সদস্যরা গিয়ে সেখানে জড়ো হওয়া প্রায় ৩০০ রোহিঙ্গাকে সরিয়ে দেন এবং ব্যানার হাতে থাকা এক রোহিঙ্গা নেতাকে আটক করে নিয়ে যান।

তবে আইএসপিআরের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাশিদুল হাসান রয়টার্সকে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের বিক্ষোভের কোনো তথ্য তার কাছে নেই।