জারের পানিতে দূষণ: পল্টন-মতিঝিলে অভিযানে বিএসটিআই

অনুমোদন না নিয়ে বা সঠিকভাবে মান নিয়ন্ত্রণ না করে জারের পানি বিক্রি বন্ধে রাজধানীর পল্টন ও মতিঝিল এলাকায় অভিযান চালিয়েছে সরকারের মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা-বিএসটিআই।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Jan 2018, 06:49 AM
Updated : 22 Jan 2018, 11:52 AM

সোমবার ভোর থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত চলা এ অভিযানে ১২টি প্রতিষ্ঠানের প্রায় চার হাজার জার বাজেয়াপ্তের পর ধংস করে দেওয়া হয়। এ সময় এক লাখ ৩৩ হাজার টাকা জরিমানা করে বিএসটিআইর ভ্রাম্যমাণ আদালত।

এ সময় একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলাও করা ছাড়াও দুই এলাকায় ১৫টি পানিবাহী ভ্যান আটক করেন বিএসটিআইর কর্মকর্তারা। কোনো অভিযোগ না পাওয়ায় তিনটি প্রতিষ্ঠানের গাড়ি ছেড়ে দেওয়া হয়। বিএসটিআইয়ের অনুমোদন থাকা এ তিনটি প্রতিষ্ঠানের পানিতে কোনো সমস্যা পায়নি ভ্রাম্যমাণ আদালত।

বিএসটিআইর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাজমা সিদ্দিকা বেগমের নেতৃত্বে অভিযানে অংশ নেন নিয়ন্ত্রক সংস্থার পরিচালক মো. ইসহাক আলী, সহকারী পরিচালক আবু সাঈদ, তালাত মাহমুদ, আরাফাত সরকার, মো. রিয়াজ উদ্দিনসহ কর্মকর্তারা। তাদের সঙ্গে ছিলেন আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা।

যে ১২টি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালানো হয় তার মধ্যে ১০টিরই বৈধ অনুমতি নেই বলে সাংবাদিকদের জানান নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাজমা সিদ্দিকা বেগম। আর অন্য দুটি প্রতিষ্ঠান নিয়ম মেনে পানি বাজারজাত করেনি।

তিনি বলেন, “শাস্তি পাওয়া প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের অপরাধ প্রায় একই ছিল। তাদের পণ্যের গায়ে বিএসটিআইর অনুমোদন সংক্রান্ত লোগো ছিল না। এছাড়া এসব জারে তৈরি এবং মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ ছিল না। দুটি প্রতিষ্ঠান লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করেছে।

“এছাড়া তাদের জারগুলো কোন কোম্পানি তৈরি করছে তারও কোনো চিহ্ন ছিল না।”

বিএসটিআইর পরিচালক মো. ইসহাক আলী বলেন, এ ধরনের অভিযান চলমান কার্যক্রমের অংশ। তবে জারের পানি কেনার আগে ভোক্তাদের সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

“কোনো প্রতিষ্ঠানের কোনো নাম ঠিকানা নেই। নাম ঠিকানাবিহীন প্রতিষ্ঠানের পানি আপনারা কিনবেন না। তার বিএসটিআইর লাইসেন্স আছে কিনা তা দেখে পানি কিনবেন।”

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) একদল গবেষক সম্প্রতি বোতলজাত ও জারের পানিতে খনিজ উপাদানের মাত্রা ও গুণাগুণ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ভীতিকর তথ্য তুলে এনেছেন।

তারা দেখেছেন, ঢাকার বাসাবাড়ি, অফিস-আদালতে সরবরাহ করা ৯৭ ভাগ জারের পানিতে মানুষ ও প্রাণীর মলের জীবাণু ‘কলিফর্ম’ রয়েছে ক্ষতিকর মাত্রায়।

ঢাকার ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, এলিফ্যান্ট রোড, নিউ মার্কেট, চকবাজার, সদরঘাট, কেরানিগঞ্জ, যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল, বাসাবো, মালিবাগ, রামপুরা, মহাখালি, গুলশান, বনানী, উত্তরা, এয়ারপোর্ট, ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, গাবতলী, আমিনবাজার, আশুলিয়া ও সাভার এলাকা থেকে আড়াইশ জারের পানির নমুনা পরীক্ষা করে গবেষকরা দেখতে পান, প্রতি ১০০ মিলিলিটার পানিতে টোটাল কলিফর্মের মাত্রা ছিল ১৭ থেকে ১৬০০ এমপিএন (মোস্ট প্রবাবল নম্বর) এবং ফিকাল কলিফর্মের মাত্রা ছিল ১১ থেকে ২৪০ এমপিএনের মধ্যে।

টোটাল কলিফর্ম ও ফিকাল কলিফর্ম পানির সম্ভাব্য দূষণের পরিমাণ নির্দেশ করে। টোটাল কলিফর্ম পরিমাপে পানিতে প্রাকৃতিকভাবে বিদ্যমান এবং মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর অন্ত্রে উপস্থিত অনুজীব ও মলমূত্র দ্বারা দূষণের সম্মিলিত মান পাওয়া যায়। আর ফিকাল কলিফর্ম পরিমাপে শুধু মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর অন্ত্র ও মলমূত্রের দ্বারা দূষণের মাত্রা জানা যায়।

ওই গবেষক দলের প্রধান মনিরুল ইসলাম গতমাসে  বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জারের পানিতে টোটাল কলিফর্ম ও ফিকাল কলিফর্মের পরিমাণ শূন্য থাকার কথা। কিন্তু ৯৭ ভাগ জারের পানিতে দুটোরই উপস্থিতি রয়েছে, যা  জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।”

কলিফর্ম মূলত বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও প্রোটোজোয়ার মতো প্যাথোজেন সৃষ্টির পরিবেশ তৈরি করে দেয়। কলিফর্ম গোত্রের অণুজীব ই-কোলাই ডায়রিয়া, মাথা ব্যথা, বমিভাব, পেট ব্যথা, জ্বর-ঠাণ্ডা, বমির মত নানা উপসর্গ সৃষ্টি করে, পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।

সংক্রমণের মাত্রা বেশি হলে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু এবং ষাটোর্ধ্বদের মধ্যে হেমোলাইটিক ইউরেমিক সিনড্রম দেখা দিতে পারে। এই রোগের কারণে লোহিত কণিকা ক্রমান্বয়ে ধ্বংস হতে থাকে এবং অনেক ক্ষেত্রে মারাত্মক কিডনি জটিলতা দেখা দেয়।

কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের ওই গবেষক দলের মতে, বিএসটিআই মান নির্ধারণ করে দিলেও কার্যকর কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় অবাধে চলছে অপরিশোধিত পানির ব্যবসা।

স্যুয়ারেজ লাইনে ছিদ্রসহ বিভিন্নভাবে ওয়াসার পানিতে মলমূত্রের জীবাণু মিশে যায়। আর তা কিছুটা শোধন করে বা শোধন ছাড়াই জারে ভরে বিক্রি করা হচ্ছে বলেই জীবাণু থেকে যাচ্ছে বলে গবেষকরা মনে করছেন।