‘নিখোঁজের অভিযোগ অস্বীকার করে পুলিশ দায় এড়াতে পারে না’

সাতক্ষীরার কুখরালীর শেখ মোখলেছুর রহমান জনির সন্ধান বের করতে না পারা এবং তার নিখোঁজের বিষয়ে মামলা বা জিডি না নেওয়ার মাধ্যমে সাতক্ষীরা সদর থানা পুলিশ তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে চরম অদক্ষতা ও অবহেলার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে বলে পুলিশেরই একটি শাখার তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Jan 2018, 07:11 PM
Updated : 21 Jan 2018, 07:14 PM

জনিকে গ্রপ্তার ও পরবর্তীতে সাতক্ষীরা সদর থানা থেকে তার নিখোঁজ সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) অনুসন্ধান প্রতিবেদনে এই পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

বিচারপতি কাজী রেজাউল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহর হাই কোর্ট বেঞ্চে রোববার প্রতিবেদনটি দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক কাউকে গ্রেপ্তার করা হলে সংশ্লিষ্ট বাহিনীর কর্তব্য যথাসময়ে তাকে আদালতে উপস্থাপন করা। আর নিখোঁজের এ কাজটি কোনো অপরাধী চক্রের হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব আরও বেশি। যাতে ভিকটিম ও অপরাধী চক্র উভয়কে খুঁজে বের করে আদালতে উপস্থাপন করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। মানুষ নিখোঁজের অভিযোগ অস্বীকার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার দায় এড়াতে পারে না।”

হোমিও চিকিৎসক মোকলেসুর রহমান জনির নিখোঁজের বিষয়ে পিবিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “সার্বিক অনুসন্ধানে ও থানার রেকর্ডপত্রসহ (জিডি ও হাজত রেজিস্ট্রার) দালিলিক সাক্ষ্য এবং সাক্ষীদের জবানবন্দি পর্যালোচনায় গত ৪ থেকে ৮ অগাস্ট পর্যন্ত জনি নামের কোনো ব্যক্তিকে সাতক্ষীরা থানা পুলিশ কর্তৃক গ্রেপ্তার পূর্বক আটক রাখা এবং পরবর্তীতে নিখোঁজ হওয়া সম্পর্কে এমন কোনো তথ্য বা সাক্ষ্য-প্রমাণাদি পাওয়া যায়নি।

“মৌখিক সাক্ষ্য অনুযায়ী ভিকটিমকে এসআই হিমেল কর্তৃক থানায় আনার বিষয়টি প্রকাশিত হলেও এ সকল সাক্ষীরা হল অভিযোগকারী কর্তৃক উপস্থাপিত সাক্ষী। কোনো নিরপেক্ষ সাক্ষী দ্বারা থানায় আনার বিষয়টি প্রমাণিত হয়নি। থানায় রক্ষিত সকল রেজিস্ট্রার পর্যালোচনাকালেও থানা হেফাজতে ভিকটিমকে রাখার বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ফলে এসআই হিমেল কর্তৃক ভিকটিমকে গ্রেপ্তারপূর্বক থানা হেফাজতে রাখার বিষয়টি অস্পষ্ট।”

জনি নিখোঁজের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জড়িত নাকি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে কোনো অপরাধী চক্র এ ঘটনা ঘটিয়েছে তা প্রমাণ করা যায়নি উল্লেখ করে পিবিআই বলেছে, “সদর থানার তৎকালীন ওসি মো. এমদাদুল হক শেখের পরবর্তী ওসি ফিরোজ হোসেন মোল্লা তার সময়কালে অভিযোগের বিষয়ে কোনো আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় নিখোঁজ জনির প্রকৃত অবস্থান জানার আরও একটি সুযোগ নষ্ট হয়েছে মর্মে কমিটির নিকট অনুমেয়।”

নিখোঁজ জনির অবস্থানসহ পুরো ঘটনা পিবিআইর মাধ্যমে তদন্ত করতে গত বছরের ১৬ জুলাই নির্দেশ দিয়েছিল হাই কোর্ট। পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দিয়ে আদালতে প্রতিবদেন দাখিল করতে বলা হয়েছিল। এর ধারাবাহিকতায় রোববার ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তাপস কুমার বিশ্বাস প্রতিবেদনটি আদালতে দাখিল করেন।

পরে তাপস সাংবাদিকদের বলেন, “পিবিআইর তদন্ত প্রতিবেদনটি আইজিপির মাধ্যমে এসে পৌঁছেছে। আজ আদালতে প্রতিবেদনটি দাখিল করা হয়েছে। রিট আবেদনকারীর পক্ষ সময়ের আবেদন করায় আদালত বিষয়টি মঙ্গলবার শুনানির জন্য রেখেছে।”

নিখোঁজ মোখলেছুরের স্ত্রী জেসমিন নাহারের ভাষ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ৪ অগাস্ট রাত সাড়ে ৯টার দিকে সাতক্ষীরা শহরের নিউমার্কেট এলাকা থেকে তার স্বামী মোখলেছুর রহমান জনিকে আটক করে সাতক্ষীরা সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) হিমেল হোসেন।

ওই রাতে তাদের বাড়িতে তল্লাশি করে সদর থানা পুলিশ। ৫, ৬ ও ৭ অগাস্ট থানায় গিয়ে তিনি স্বামীর সঙ্গে দেখা করে খাবারও দিয়ে আসেন। ৮ অগাস্ট থানায় গিয়ে তিনি স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে থানা থেকে বলা হয়, মোখলেছুর রহমান জনি নামে থানায় কেউ নেই।

পরে স্বামীর খোঁজ না পেয়ে তার স্ত্রী জেসমিন নাহার গত বছরের ২ মার্চ হাই কোর্টে রিট (হেবিয়াস করপাস) আবেদন করেন।

পরে এ রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ৬ মার্চ হাই কোর্ট রুল জারির পাশাপাশি নিখোঁজ ব্যক্তির বিষয়ে সাতক্ষীরা পুলিশ সুপারকে ব্যাখ্যা জানাতে নির্দেশ দেয়। সাতক্ষীরা পুলিশের ব্যাখ্যায় বলা হয়, মোখলেছুর রহমান নামের কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।

আদালত তখন এ ঘটনার তদন্ত করে পুলিশ প্রধানকে প্রতিবদন দিতে বলে। ওই প্রতিবেদনও জমা পড়ে আদালতে। কিন্তু আদালত ফের বিচারিক তদন্তের নির্দেশ দেয়। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী সাতক্ষীরার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম হাবিবুল্লাহ মাহমুদ ঘটনা তদন্ত করে হাই কোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করেন।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, “পুলিশ কর্তৃক জনিকে গ্রেপ্তার ও তিনদিন পর্যন্ত থানায় আটকে রেখে পরবর্তীকালে অস্বীকারের অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে।”

কিন্তু পুলিশ ও বিচারিক তদন্তে নিখোঁজ মোখলেছুরের সন্ধান বের না হওয়ায় আদালত পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেয়। সে নির্দেশ অনুযায়ী পিবিআইয়ের (খুলনা বিভাগ) বিশেষ পুলিশ সুপার নওরোজ হাসান তালুকদারকে প্রধান করে কমিটি করা হয়। সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার, সদর থানার ওসিসহ ৩৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করে কমিটি।

প্রতিবেদনটির সুপারিশ অংশে বলা হয়, “সাধারণত এ জাতীয় অভিযোগ উত্থাপিত হলে প্রথমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ হতে তার দায় অস্বীকার করা হয়ে থাকে। কিন্তু প্রশ্ন হল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কেবল এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেই কি তার দায় এড়াতে পারে? উত্তর হল, না।

“কেননা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক কাউকে গ্রেপ্তার করা হলে সংশ্লিষ্ট বাহিনীর কর্তব্য যথাসময়ে তাকে আদালতে উপস্থাপন করা, অথবা এ কাজটি কোনো অপরাধী চক্রের হলে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর দায়িত্ব আরও বেশি, ভিকটিম ও অপরাধী চক্র উভয়কে খুজে বের করে আদালতে উপস্থাপন করা।

“অন্যথায় এ ধরনের অভিযোগ মিথ্যা কিংবা বানোয়াট হলে তা প্রমাণ করার দায়িত্বও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর বর্তায়। তাই এ ধরনের নিখোঁজ কিংবা অভিযোগের ক্ষেত্রে কোনো মামলা বা জিডি না নেওয়ার মাধ্যমে সাতক্ষীরা জেলা সদর থানা পুলিশ তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে চরম অদক্ষতা ও অবহেলার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে, যা শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য মোটেই কাম্য নয়।’

এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, সার্বিক পর্যালোচনায় সাতক্ষীরা সদর থানা পুলিশের তৎকালীন ওসি মো. এমদাদুল হক শেখ ও এসআই হিমেল এবং পরবর্তীতে ওসি ফিরোজ হোসেন মোল্লাসহ সংশ্লিষ্ট সব পুলিশ সদস্যের তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তৃব্যকর্ম যথাযথভাবে পালন না করায় অদ্যাবদি নিখোঁজ হওয়ার প্রকৃত ঘটনা যেমন উদঘাটিত হয়নি, তেমনিভাবে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে।

“এ প্রেক্ষিতে আলোচ্য ঘটনায় সাতক্ষীরা সদর থানা পুলিশ সদস্যের মধ্যে যারা অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্যকর্ম পালনে চরম অদক্ষতা এবং অবহেলা করেছে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।”