প্রত্যাবাসনের ‘শর্ত ঠিক করছে’ রোহিঙ্গারা  

নিপীড়নের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর প্রস্তুতির মধ্যেই নাগরিকত্বের অধিকার, ভূমি ফিরে পাওয়া এবং হত্যা-ধর্ষণ-লুটপাটের বিচারসহ কয়েক দফা শর্ত নিয়ে সামনে আসার পরিকল্পনা করছেন কুতুপালং ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গা নেতারা। 

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Jan 2018, 03:12 PM
Updated : 19 Jan 2018, 04:14 PM

বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ছয়জন রোহিঙ্গা নেতা বার্মিজ ভাষায় হাতে লেখা একটি স্মারকলিপির খসড়া তৈরি করেছেন; সেখানেই ওই দাবিগুলো লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

এই রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ৪০টি গ্রামের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছেন তারা। তাদের স্মারকলিপি চূড়ান্ত হলেই তা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের কাছে তা তুলে ধরা হবে।

ওই খসড়ায় বলা হয়েছে, মিয়ানমার সরকার যতক্ষণ না এসব দাবি পূরণ করছে, ততক্ষণ আশ্রয় শিবির থেকে কোনো রোহিঙ্গা মুসলমান ফিরে যাবে না।

রোহিঙ্গাদের দাবির মধ্যে রয়েছে-

>> দীর্ঘদিন নাগরিকত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে নিয়ে সরকারি ঘোষণা দিতে হবে। মিয়ানমারের স্বীকৃত জাতিগোষ্ঠীর তালিকাতেও রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত করে নিতে হবে। 

>> যে ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে, সেই ভূমি, বাড়িঘর, মসজিদ আর স্কুল তাদের ফিরিয়ে দিতে হবে। 

সেনা অভিযানের নামে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।

>> সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নামে যেসব ‘নিরপরাধ’ রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে, তাদের মুক্তি দিতে হবে। 

>> মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম এবং ফেইসবুক পেইজগুলোতে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে ছবিসহ যে তালিকা প্রকাশ করা হচ্ছে- তা বন্ধ করতে হবে।

কুতুপালং আশ্রয় শিবিরে যে রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে রয়টার্স কথা বলেছে, তারা জানিয়েছেন, তাদের স্মারকলিপি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। ক্যাম্পে থাকা ৪০ রোহিঙ্গা গ্রামের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করেই দাবিগুলো তারা লিপিবদ্ধ করেছেন। 

আর স্মারকলিপি যেহেতু দেওয়া হয়নি, সেহেতু আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলো এখনই কোনো মন্তব্য করতে চায়নি বলে জানিয়েছে রয়টার্স।

 

গতবছর ২৫ অগাস্ট রাখাইনে নতুন করে সেনা অভিযান শুরুর পর এ পর্যন্ত সাড়ে ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের অধিকাংশই আছে কক্সবাজারের কুতুপালং ক্যাম্পে।

গত ১৬ জানুয়ারি মিয়ানমার ও বাংলাদেশের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে, তাতে আগামী সপ্তাহে শুরু করে দুই বছরের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শেষ করার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে।

রয়টার্স লিখেছে, এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সফল করতে যে বিপুল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে, রাহিঙ্গাদের এই দাবিনামা তার একটি নমুনা।

ওই চুক্তিতে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য সীমান্তে পাঁচটি ট্রানজিট ক্যাম্প খুলবে বাংলাদেশ। সেখান থেকে তাদের নিয়ে প্রাথমিকভাবে রাখা হবে মিয়ানমারের দুটি ক্যাম্পে। পরে সাময়িকভাবে তাদের থাকার ব্যবস্থা হবে হ্লা পো কুংয়ের অস্থায়ী ক্যাম্পে।

এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, রোহিঙ্গারা তাদের গ্রামে ফিরতে পারবে, নাকি তাদের ক্যাম্পেই থাকতে হবে- সে বিষয়টি স্পষ্ট করা দরকার।

মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও এ মুহূর্তে প্রত্যাবাসন শুরুর বিরোধিতা করেছে।

তাদের ভাষায়, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মনে এখনও ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতনের দগদগে ক্ষত। এই অবস্থায় তাদের ফেরত পাঠানো সময়োচিত হবে না।

রাখাইনে কয়েকশ বছর ধরে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বসবাসের ইতিহাস থাকলেও  ১৯৮২ সালে আইন করে তাদের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতাই রোহিঙ্গাদের বর্ণনা করে আসছেন ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ ও ‘অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে।

মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম এ সপ্তাহেও রোহিঙ্গাদের ছবিসহ একটি তালিকা প্রকাশ করে বলেছে, এরা আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সদস্য। রোহিঙ্গাদের ওই বিদ্রোহী দলটিকেই ২৫ অগাস্টের হামলার জন্য দায়ী করা হচ্ছে।   

ওই হামলার পর সেনাবাহিনী সন্ত্রাস দমনের নামে রাখাইনের গ্রামে গ্রামে যে অভিযান শুরু করেছিল, জাতিসংঘ তাকে চিহ্নিত করে আসছে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে। 

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এতদিন হত্যা-ধর্ষণের অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করে এলেও সম্প্রতি দেশটির সেনাপ্রধান এক বিবৃতিতে ১০ রোহিঙ্গাকে ধরার পর হত্যার কথা স্বীকার করে নেন।

রয়টার্স লিখেছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এমন স্বীকারোক্তি বিরল ঘটনা। 

ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ঊপকূলীয় ইন দীন গ্রামে একটি গণকবরে ওই ১০ জনের দেহাবশেষ পাওয়া যায়। পরে আরসার পক্ষ থেকে বলা হয়, নিহত ওই দশজন বেসামরিক নাগরিক ছিলেন, আরসার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল না।

এদিকে প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতির মধ্যেই নতুন করে আরও রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে বুধবার।   

রয়টার্স জানিয়েছে, শতাধিক রোহিঙ্গা সেদিন সীমান্ত পেরিয়ে কক্সবাজারে ঢুকেছে; আরও বহু রোহিঙ্গা নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে আসার অপক্ষায় রয়েছে।

নতুন করে যারা এসেছেন, তাদের বরাত দিয়ে রয়টার্স লিখেছে, সিয়েন ইন পাইন গ্রামে সেনা অভিযানের কারণে তারা এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। তরুণ রোহিঙ্গাদের ধরে নিয়ে যাওয়ার এবং পুকুরে, জঙ্গলে লাশ পড়ে থাকতে দেখার কথাও অনেকে বলেছেন।  

এই রোহিঙ্গারা বলেছেন, দিনের পর দিন তাদের অভুক্ত অবস্থায় লুকিয়ে থাকতে হয়েছে। জীবন বাঁচাতেই তাদের গ্রাম ছাড়তে হয়েছে।

মিয়ানমারের সেনা নিয়ন্ত্রিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র পুলিশের কর্নেল মায়ো থু সু রয়টার্সকে বলেছেন, রাখাইনের গ্রামে কোনো অভিযান এখন চলছে না।

তবে নিরাপত্তা বাহিনী এখনও রাখাইনের উত্তরাংশে ‘নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা’ করছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।