নগরে রসের মেলা

কুয়াশামাখা হিম ভোরে গ্রামের আলপথ মাড়িয়ে রসভর্তি ভার নিয়ে চলেছে গাছি; থেমে থেমে ভেসে আসে তার হাঁক ‘লাগবে রস, খেঁজুর রস’।  সে রসের সঙ্গে আসে পাটালি বা নলেন গুড়; গুড়ে তৈরি হয় নানা জাতের পিঠা। মুড়ি-মুড়কি-বাতাসার সঙ্গে গ্রামবাসী সেরে নেয় প্রাতঃরাশ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Jan 2018, 06:39 AM
Updated : 25 Jan 2019, 05:18 AM

গ্রামবাংলার এই ঐতিহ্যের সঙ্গে নগরে তরুণদের পরিচয় করিয়ে দিতে রঙ্গে ভরা বঙ্গ শুক্রবার সকালে আয়োজন করল ‘রসের মেলা’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় হয়ে এই উৎসবের উদ্বোধন করেন কথাসাহিত্যিক হায়াৎ মামুদ।

আয়োজনে প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সচিব আকতারী মমতাজ। বিশেষ অতিথি হিসেবে এসেছিলেন বাংলা একাডেমির ফোকলোর বিভাগের পরিচালক শাহিদা খাতুন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউডার চারুকলার অধ্যাপক আলাউদ্দিন আহমেদ, কোরিয়ান উন্নয়ন সংস্থা কইকার কান্ট্রি ডিরেক্টর ক্যারি হিউনগু জুয়ে।

হায়াৎ মামুদ বলেন, “গ্রামাঞ্চলে এখনো খেজুর রসের উৎসব হয়। আমার মনে হয়, শীতের মৌসুমে আমরা চুরি করে রস খেতে যেতাম। আমরা এই উৎসবে এসে ফেলে আসা শৈশবের কথা স্মরণ করি। এ উৎসবে আসুন সকলের মিলে গ্রামের জন্য মঙ্গল কামনা করি, গ্রামগুলো যেন ভালো থাকে।”

আকতারী মমতাজ বলেন, “রস উৎসব মনে করিয়ে দেয় পুরনো স্মৃতি। রস উৎসব মনে করিয়ে দেয়, বাঙালির রসবোধের কথা।”

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে উঠে আসা লোকজ উপাদানের গবেষক শাহিদা খাতুন বলেন, “রস উৎসব বাঙালির সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির উৎসব। আমরা অতীতের ঐতিহ্যকে ধারণ করে বাংলার আবহমান সংস্কৃতিকে আরো এগিয়ে নেব, এই শপথ নেই। আমরা যেন কোনোভাবেই ঐতিহ্যবিমুখ হয়ে না পড়ি, সেজন্য নগরে এ উৎসব বড় প্রয়োজন।”

সকাল সাড়ে ৮টায় জনি বয়াতি ও তার দলের লোকজ সংগীত পরিবেশনায় শুরু হয় রস উৎসব। বাঁশির সুরে ‘এই পদ্মা এই মেঘনা’ পরিবেশনায় শুরু করে তারা গেয়ে শোনায় ‘বন্ধু আমার হাওয়াই মিঠাই’ ও ‘বন্ধুর বাড়ি আমার বাড়ি’ গানগুলো।

মাটির কলসি আর ভারে করে এল খেজুর রস, সঙ্গে ছিল নলেন গুড়ের পিঠা। মুড়ি, মুড়কি আর বাতাসাই বা বাদ যাবে কেন! শীতের রাতে ‘দস্যি দলের’ রস চুরি, খেজুর গুড়ের পায়েস আর পিঠাপুলির স্মৃতিচারণ করলেন তারা। মাটির গ্লাসে আসা খেজুর রসে চুমুক দিতেই কজন হা-পিত্যেষও করলেন-‘কোথায় গেলো সেই শৈশব!”

শিশুসাহিত্যিক আহমেদ রিয়াজ এসেছিলেন সপরিবারে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ছেলেদের গ্রামীণ ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে এই রস উৎসবে এসেছি। গ্রামের লোকজ উৎসবে যোগ দেওয়ার সুযোগ কম। শহরেই রস আস্বাদনের সুযোগ মিস করতে চাইনি।”

রাজধানীর খিলগাঁও থেকে সস্ত্রীক এসেছিলেন সাংবাদিক এস এম মুন্না।

তিনি বলেন, “খেঁজুর রসের স্বাদ কতদিন পাই না! সেই কবে ফেলে এসেছি ছেলেবেলা। গ্রামের এ ঐতিহ্যগুলোকে শহরে তুলে ধরে আয়োজকরা শুধু তরুণদের সংস্কৃতি সম্পৃক্ততা বাড়াচ্ছেন তা নয়- নগরে লোকজ ঐতিহ্যের চর্চা যেন বন্ধ হয়ে না যায়, এ উৎসবটি সে বার্তাও দেয় আমাদের।”

আবৃত্তিশিল্পী জুবাইদা লাবণী বলেন, “নগরে যে লোকজ উৎসবগুলো হয়, তার মধ্যে রস উৎসব একটু ব্যতিক্রম। উৎসবে খেজুর রসের সাথে শুনতে আসি লোকজ সুর।”

উৎসবের আয়োজক রঙ্গে ভরা বঙ্গের অন্যতম সদস্য ইমরান উজ জামান বলেন, “সপ্তমবারের মতো আমরা এই উৎসবটি আয়োজন করছি। উৎসবে রসের পাশাপাশি লোকজ উপাদানগুলোও রাখার চেষ্টা করছি। প্রজন্ম যেন কোনোভাবে আমাদের শেকড়ের কথা ভুলে না যায়, তার চর্চা বৃদ্ধির জন্য এই আয়োজন।”

সকাল সাড়ে ৮টায় শুরু হয়ে উৎসবটি চলে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত।