মৃত্যু সহজ, বুঝেছি আনিসের শেষ চার মাসে: রুবানা হক

প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের লন্ডনে চিকিৎসার সময় তার পাশে থাকা স্ত্রী রুবানা হক বলেছেন, বেঁচে থাকতে প্রিয়জনের ওই সংগ্রাম তাকে জীবন-মৃত্যু নিয়ে নতুন উপলব্ধি দিয়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Jan 2018, 06:49 PM
Updated : 17 Jan 2018, 07:02 PM

ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিতে এসে ঢাকা উত্তরের মেয়র হওয়া আনিসুল হকের কর্মতৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। জুলায়ের শেষ দিকে লন্ডনে বেড়াতে গিয়ে সপ্তাহ দুয়েক পরে তার গুরুতর অসুস্থ হওয়ার খবর অনেকে মেনে নিতে পারছিলেন না।

মস্তিষ্কের প্রদাহজনিত রোগ ‘সেরিব্রাল ভাস্কুলাইটিসে’ আক্রান্ত আনিসুল হক প্রায় চার মাস লন্ডনের হাসপাতালে থেকে ২৯ নভেম্বর মারা যান। ৬৫ বছর বয়সী আনিসুলের মৃত্যুর শোক ছড়ায় ঢাকার সব মহলে।

বুধবার বাংলা একাডেমিতে এক স্মরণসভায় গিয়ে স্বামীর মৃত্যু নিয়ে নিজের জীবনাভিজ্ঞতায় পরিবর্তনের কথা জানালেন তার স্ত্রী রুবানা।

তিনি বলেন, “জীবন বড় নিষ্ঠুর। আনিসের সঙ্গে কাটানো শেষ চার মাসে আমি অনুভব করলাম, মৃত্যু সহজ, তার চেয়ে বেঁচে থাকা অনেক কঠিন।”

আনিসুল হক এই পৃথিবী ছেড়ে গেলেও এখনও চারপাশে তাকে অনুভব করেন বলে জানান রুবানা হক: “আমার চারপাশে আনিস এখনও আছেন। পরিবারের প্রতিটি মানুষ আমরা অপেক্ষায় থাকি, কোনো এক সময় আনিস দরজা দিয়ে ঢুকবে। আমার ছেলে-মেয়েরা যখন কথা বলে আমি আনিসকে খুঁজে পাই।”

দাম্পত্য জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রুবানা বলেন, “আমি আনিসের সবচেয়ে বড় সমালোচক, তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষীও আমি। তাকে হারিয়ে শুধু স্বামী বা প্রেমিককে হারাইনি। আমি যে জীবনের শতকরা নব্বই ভাগ তার প্রতি নিবেদন করেছিলাম।”

‘বীরের মতো’ প্রস্থানের আগে আনিসুল হক নিজেকে জনগণের সেবক হিসেবে ‘নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

আগামী মাসেই আনিসুল হকের টিভি চ্যানেল নাগরিক আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করবে বলে জানান রুবানা।

শিল্পীর অধিকার ও স্বার্থ রক্ষায় আনিসুল হকের গড়ে তোলা ‘শিল্পীর পাশে ফাউন্ডেশন’ রাতে বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে এই স্মরণ সভার আয়োজন করে।

সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বিশেষ অতিথি ছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, অধ্যাপক-লেখক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ, কণ্ঠশিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদী, টিভি ব্যক্তিত্ব নওয়াজেশ আলী খান।

আসাদুজ্জামান নূর বলেন, “আমি যখন অভিনয় থেকে রাজনীতিতে এলাম, তখন আনিস আমাকে নানাভাবে খোঁচাত। কিন্তু সে যখন ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিতে আসছে, তখন সে আমাকে বলল, আমরা কি ঠিক করলাম? আমি বললাম, অবশ্যই ঠিক করেছি। তার মতো সুস্থ ও সৎ চিন্তার মানুষকে রাজনীতিতে বড় দরকার।”

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, “প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর মানুষটি কয়েক মাসের মধ্যে নিঃশেষ হয়ে যাবে, এটা বিশ্বাস করা কঠিন। মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়ে তার মধ্যে ছিল সাহস আর সংকল্প। সাধারণ মানুষের জন্য ছিল তার অসম্ভব দরদ।”

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, “আমাদের দেশে স্টার নেই একেবারে। আনিস ছিল আমাদের স্টার। টিভি অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে ব্যবসা, তারপর সমাজ হিতকর কাজ, সবকিছুতেই সে ছিল স্টার।”

সেলিনা হোসেন বলেন, “প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের মাধ্যমে আনিস সমাজ পরিবর্তনের চিন্তা করত, স্বপ্ন দেখত। আমাদের উন্নয়ন তো শুধু ইট, কাঠ, পাথরের মাধ্যমে নয়। সে বিশ্বাস করত, সৃজনশীল মানুষের জ্ঞানের জায়গা থেকেই উন্নয়ন আসবে। আমি তার মৃত্যুকে মেনে নিতে পারিনি, এ মৃত্যুর ক্ষতি বড় অপূরণীয়।”

জুয়েল আইচ বলেন, “আনিস সব সময় বলত, সে অদ্ভূত কিছু করবে, আলাদা কিছু করবে। সবকিছুর শেষটা সে দেখতে চাইত।”

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, “গোটা ঢাকা শহরের দেয়ালকে চিত্রকলায় সুসজ্জিত করার পরিকল্পনা করেছিলেন আনিস। তার মধ্যে এক নিজস্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দেখেছি, তার মন ছিল তারুণ্যমণ্ডিত।”

সভার শুরুতে শিল্পীর পাশে ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস, কার্যক্রম ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন সংগঠনটির মহাসচিব ব্যারিস্টার ওমর সাদাত।

শিল্পীর পাশে ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য সৈয়দ আবদুল হাদী বলেন, “স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে তিনি প্রমাণ করে গেছেন সততা, দক্ষতা, আন্তরিকতা যোগ্যতা থাকলে কোনো কিছু করা অসম্ভব নয়। তার অকাল প্রয়াণে গোটা দেশবাসী হারালো এক সুহৃদকে। এমন একজন আনিসুল হকের জন্য আরো কতদিন অপেক্ষা করতে হবে জানা নেই। আদৌ এমন সারথি পাব কি না আমাদের জানা নেই।”

বিটিভিতে ঈদ আনন্দমেলা নির্মাণ করতে গিয়ে আনিসুল হকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে নওয়াজেশ আলী খানের।

সেই স্মৃতি ‍তুলে ধরে তিনি বলেন, “উনি টিভিতে এসেছিলেন কৃষি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। মাস্টার্স পড়ুয়া ছাত্রটির মধ্যে চ্যালেঞ্জিং কিছু দেখেছিলাম সেদিন। আমি তখন বললাম তার বাচনভঙ্গি, পরিশীলিত উপস্থাপনার ভঙ্গি ভালো লেগে গেল আমাদের। তারপর তাকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর ঈদের আনন্দমেলা করেন, আমার প্রযোজনায় ছিল।

“বাংলাদেশ টেলিভিশনে সে অনুষ্ঠানে ‘পৃথিবী আমারে চায়’ গানের সঙ্গে মিউজিক ভিডিও প্রচারিত হয়। এ পরিকল্পনায় আমাদের সঙ্গে ছিল আনিস। আমাদের দেখা উপস্থাপকদের সেরা তিন পারফেকশনিস্টদের একজন আনিসুল হক।”

পরে টিভি অনুষ্ঠান ‘অন্তরালে’র নানা স্মৃতিও তুলে ধরেন নওয়াজেশ আলী খান।

আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ঢাকা উত্তরে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলামও এই স্মরণ সভায় যোগ দিয়েছিলেন।

তিনি বলেন, “আজকে আমাকে প্রশ্ন করেন, কীভাবে সুন্দর আগামীর ঢাকা গড়ে তুলব? আমি তো মনে করি, আনিস ভাই যে এজেন্ডা ও ম্যানিফেস্টো ঠিক করে গেছেন, আমার কাজ খুব সহজ হয়ে গেল। তার প্রতিটি অক্ষর মেইনটেইন করতে পারলেই হল। জুয়েল আইচ জাদু দেখান, কিন্তু আনিস ভাই সে জাদু সত্যি করে দেখিয়ে গেছেন।”

অনুষ্ঠান শুরুর আগে সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল, বুলবুল ইসলাম ও শারমিন সাথী ইসলাম।