সাদ সমর্থক তাবলিগের নেতারা বলছেন, ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসা থেকে বিরোধিতা আসার পর মাওলানা সাদ তার ১৯ দফা থেকে সরে এসেছেন। তারপরও বিশ্ব ইজতেমা ঘিরে বাংলাদেশে তাবলিগের একটি অংশ বিতর্ক তৈরি করেছে, যেখানে বড় শক্তি হিসাবে কাজ করেছে হেফাজতে ইসলাম।
বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের মূল কেন্দ্র কাকরাইল মসজিদের একটি শাখার আমির মিজানুর রহমান শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তাবলিগের নাম করে হেফাজতের কর্মীরা আর মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা বিমানবন্দর এলাকায় ওই গণ্ডগোল করেছে। পিঠ বাঁচানোর স্বার্থে তারা তাবলিগের নাম ব্যবহার করেছে। আর সরকার হেফাজতের কাছে নতি স্বীকার করেছে।”
এ অভিযোগ নাকচ করে হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওলামায়ে কেরাম, যারা ইসলামী ধ্যান ধারণা ধারণ করেন, তারাই আন্দোলন করেছেন। তাবলিগের বিরোধী কোনো বক্তব্য আমরা দিইনি। আমিও তাবলিগে যাই। এর সাথে হেফাজতের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।”
বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব ফয়জুল্লাহ এই বক্তব্য দিলেও বুধবার বিমানবন্দরের সামনের রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাই ছিল বলে তাবলিগ জামাতের অনেকে বলেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাবলিগের মুকিম পর্যায়ের একজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিমানবন্দর মোড়ের অবরোধে বড় একটা অংশ এসেছিল বারিধারা মাদ্রাসা থেকে, যেটার প্রধান হেফাজতের ঢাকা মহানগরীর আমির নূর হোসাইন কাসেমী। ওই এলাকার বিমানবন্দর মাদ্রাসার পাশাপাশি উত্তরা থেকে কিছু সাধারণ তাবলিগকর্মীও সেখানে যোগ দিয়েছিল।”
তাবলিগের এ অংশটি সাদবিরোধী অংশের সমর্থক বলে জানান তিনি।
২০১৫ সাল থেকে বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করছিলেন মাওলানা সাদ। তার আগে হেদায়েতি বয়ান দিতেন তিনি।
এবার বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে মাওলানা সাদের ঢাকা আসার খবরে বুধবার সকাল থেকে বিমানবন্দর এলাকায় বিক্ষোভ করেন তাবলিগ জামাতের একাংশ। বিকাল ৪টা পর্যন্ত ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ ওই সড়কে বিক্ষোভে দিনভর যানজটে ভুগতে হয় মানুষকে।
পরদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের মধ্যস্থতায় মাওলানা সাদের ইজতেমায় যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। শুক্রবার কাকরাইল মসজিদে বয়ান, মোনাজাত এবং বাংলাদেশি ও বিদেশি তাবলিগ জামাত অনুসারীদের সঙ্গে বৈঠকে সময় পার করেন তিনি।
মাওলানা সাদের দাদা ভারতের ইসলামি পণ্ডিত ইলিয়াছ কান্ধলভি ১৯২০ এর দশকে তাবলিগ জামাত নামের এই সংস্কারবাদী আন্দোলনের সূচনা করেন। স্বেচ্ছাসেবামূলক এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ইসলামের মৌলিক মূল্যবোধের প্রচার। বিতর্ক থেকে দূরে রাখতে এ সংগঠনে রাজনীতি ও ফিকাহ নিয়ে আলোচনা হয় না। ভারতীয় উপমহাদেশের সুন্নি মতাবলম্বী মুসলমানদের বৃহত্তম এই ধর্মীয় সংঘের মূল কেন্দ্র বা মারকাজ দিল্লিতে।
মাওলানা ইলিয়াছের মৃত্যুর পর তার ছেলে মাওলানা মোহাম্মদ ইউসুফ এবং তারপর মাওলানা ইনামুল হাসান তাবলিগ জামাতের আমিরের দায়িত্ব পালন করেন। মাওলানা ইনামুলের মৃত্যুর পর একক আমিরের বদলে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার দেওয়া হয় একটি শুরা কমিটির ওপর।
এই শুরা কমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিলেন পাকিস্তান তাবলিগ জামাতের আমির হাজি আদুল ওয়াহহাব, মাওলানা ইনামুলের ছেলে মাওলানা জুবায়েরুল হাসান এবং মাওলানা ইউসুফের ছেলে মাওলানা সাদ।
মাওলানা জুবায়েরের মৃত্যুর পর মাওলানা সাদ আমিরের দায়িত্ব নেন এবং একক নেতৃত্বের নিয়ম ফিরিয়ে আনেন। কিন্তু মাওলানা জুবায়েরের ছেলে মাওলানা জুহাইরুল হাসান তখন নেতৃত্বের দাবি নিয়ে সামনে আসেন এবং তার সমর্থকরা নতুন করে শুরা কমিটি গঠনের দাবি জানান। কিন্তু সাদ তা প্রত্যাখ্যান করলে বিরোধ বড় আকার ধারণ করে।
মাওলানা সাদ তাবলিগ জামাতের নিজামুদ্দিন মারকাজকে মক্কা-মদীনার পর ইসলামের সবচেয়ে বড় কর্তৃপক্ষ দাবি করে বক্তব্য দিলে দেওবন্দ মাদ্রাসার ইসলামি পণ্ডিতদের সঙ্গেও তার বিরোধ স্পষ্ট হয়। ইমামতি করে বা কোরআন শিখিয়ে বেতন নেওয়ারও সাদ সমালোচনা করেন, যা বিভক্তিকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
বাংলাদেশে তাবলিগের ১১ জন শুরা সদস্যের মধ্যে সাতজন মাওলানা সাদের বাংলাদেশে আসার পক্ষে ছিলেন বলে জানান তাবলীগকর্মীরা। তবে বক্তব্যের জন্য তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কাউকে পাওয়া যায়নি।
তাবলিগের মুকিম ডা. রফিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তাবলিগ একটি অরাজনৈতিক অহিংস ধর্মভিত্তিক সংগঠন। পক্ষান্তরে হেফাজত একটি রাজনৈতিক সংগঠন। কেননা ইতোপূর্বে হেফাজত বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে একাধিক ‘ব্যর্থ বিপ্লব’ সংঘটিত করেছে।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের প্রথিতযশা লোকদের জিজ্ঞাস্য, আওয়ামী লীগের বার্ষিক সম্মেলনে কে প্রধান অতিথি হবেন, সেটা কি আওয়ামী লীগ ঠিক করবে, নাকি বিএনপি সদস্যরা ঠিক করে দেবে?
“তদরূপ বিশ্ব ইজতেমায় কে দোয়া করবে, কে আসতে পারবে আর কে আসতে পারবে না- সেটা কি হেফাজতে ইসলাম ঠিক করবে?
সাদ কান্দলভির দেওয়া ১৯ দফা বক্তব্যও সমর্থনের কথা জানান তিন বছর ধরে তাবলিগের সঙ্গে থাকা আমির মিজান; তবে বক্তব্য সংশোধনের যে সুযোগ সেটাও সাদ নিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
মিরপুর এলাকার এই ব্যবসায়ী বলেন, “আমির সাব বলেছেন, মোবাইলে কোরআন শরীফ পড়া যাবে না। কারণ, কোরআন শরীফ আছে এমন মোবাইল নিয়ে প্রস্রাব পায়খানায় যায় সবাই। আর বলেছেন, যাকাতের পয়সা গরিবদের হক, মাদ্রাসায় ব্যবহার করা যাবে না।
“সাদ সাহেব কিছু হক কথা বলেছেন, ফলে তাদের ব্যবসা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা আছে। সেজন্য তারা উনার বিরুদ্ধে গেছে।”
তাবলিগের বিরোধের মধ্যে শুক্রবার কাকরাইল মসজিদে গিয়ে সেখানকার সাধারণ মুসল্লিদের অনেককে মাওলানা সাদকে ইজতেমার মাঠে যেতে না দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়।
পটুয়াখালীসহ কিছু জেলা থেকে ইজতেমার উদ্দেশ্যে ঢাকায় এলেও তারা টঙ্গীর ইজতেমা মাঠে না গিয়ে কাকরাইল মসজিদে ছিলেন।
সকাল ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সেখানে বয়ান করেন মাওলানা সাদ। জুমার নামাজের পর মোনাজাতও পরিচালনা করেন তিনি।
ডা. রফিক জানান, যারা মাওলানা সাদের ইজতেমায় আখেরি মোনাজাত এবং বয়ানের পক্ষে ছিলেন তাদের ‘অধিকাংশই’ শুক্রবার ইজতেমা মাঠে যাননি।