একুশের বইমেলার প্রস্তুতি পর্বে প্রকাশকদের ক্ষোভ-দ্বন্দ্ব

একুশে গ্রন্থমেলার প্রস্তুতি পর্বের শুরুতেই বাংলা একাডেমির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রকাশকরা।

জয়ন্ত সাহা নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Jan 2018, 04:43 AM
Updated : 12 Jan 2018, 05:53 AM

দ্বিতীয়বারের মতো মেলার ইভেন্ট ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আসা নিরাপদ ইভেন্টসের অব্যবস্থাপনা, বাংলা একাডেমির অসম স্টল বরাদ্দ নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে প্রকাশকদের। 

এদিকে প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ ও তার আয়তন ও সীমানা নির্ধারণ নিয়ে প্রকাশকরা দুই পক্ষে বিভক্ত হয়েছেন। এদের কেউ অভিযোগ করেছেন, বাংলা একাডেমি নিজেই গ্রন্থমেলার নীতিমালার ‘ব্যত্যয়’ ঘটিয়ে প্রকাশকদের এক পক্ষের দাবি মেনে নিতে যাচ্ছে।

তবে মেলার আয়োজক কমিটির পক্ষে বাংলা একাডেমির পরিচালক (বিক্রয় ও প্রকাশনা)  ও গ্রন্থমেলা কমিটির সদস্য সচিব জালাল আহমেদ বলেছেন, “নীতিমালার বাইরে এসে কোনো সিদ্ধান্তই নেবে না বাংলা একাডেমি।”

অভিযোগ ‘অসম স্টল বরাদ্দের’

এবার মেলায় সব মিলিয়ে বাংলা একাডেমির দুটি এবং ২৩টি প্রকাশনা সংস্থাকে প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে মেলার পরিসর।

এবারের মেলায় নতুন ১২টি প্রকাশনা সংস্থাকে প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে গতবার বরাদ্দ পাওয়া সংস্থার মধ্যে এবারও ১১টিকে প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ পেয়েছে।

প্রথমবারের মতো প্যাভিলিয়ন পাওয়া নালন্দা, তাম্রলিপি, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, সময়, বাংলাপ্রকাশের প্রকাশকরা অভিযোগ করছেন,  এর আগে যারা মেলায় প্যাভিলিয়ন পেয়েছেন, তাদের ‘ষড়যন্ত্রের’ শিকার হচ্ছেন তারা।

গ্রন্থমেলার নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিটি প্যাভিলিয়নের জন্য বরাদ্দ ২০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২০ ফুটের প্রস্থের স্টল।

বৃহস্পতিবার বাংলা একাডেমি চত্বরে কথা হয় নালন্দার প্রকাশক রেদোয়ান জুয়েল, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশের আদিত্য অন্তর, তাম্রলিপির তারিকুল ইসলাম রণি, সময়ের ফরিদ আহমেদের সঙ্গে; তারা অভিযোগ করছেন, প্রকাশকদের একপক্ষের কারণে তারা এসব ‘অসম বণ্টন নীতির শিকার’ হতে চলেছেন।

নতুন প্যাভিলিয়ন পাওয়া প্রকাশকরা অভিযোগ করেছেন, আগে থেকে প্যাভিলিয়ন পেয়ে আসা প্রকাশকরা নতুনদের বইমেলার এক কোণে ঠেলে দিয়ে নিজেরা সামনের অংশে থাকতে চাইছে।

পুরনোরা ২০ ফুটের জায়গা বাড়িয়ে ২৪ ফুট করার প্রস্তাব দিলেও নতুনদের জন্য ২০ ফুট জায়গা বরাদ্দের জন্য বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষকে ‘চাপ দিচ্ছে’ বলেও অভিযোগ করেন তারা।

বৃহস্পতিবার একাধিক দফায় বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ও গ্রন্থমেলা কমিটির সদস্য সচিবের সঙ্গে আলোচনায় বসেন তারা।

ফাইল ছবি

 

শেষে সন্ধ্যায় তারিকুল ইসলাম রণি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, মেলায় কেউ বৈষম্যের শিকার হবেন না। শনিবার নাগাদ তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবেন। আমরা আশা করব, প্যাভিলিয়নের আয়তন বাড়লে তা সকলের জন্যই সমানভাবে বাড়বে। পুরনো, নতুনের বৈষম্য থাকবে না।”

আদিত্য অন্তর বলেন, “আমরা শনিবারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করছি। দেখি কী হয়।”

অন্যদিকে নীতিমালা অনুযায়ী  ‘মানসম্মত’ সৃজনশীল বই প্রকাশ করা হয়েছে, এমন দাবি জানিয়ে প্রকাশনা সংস্থা বেহুলা বাংলা, খড়িমাটি ও টাপুর টুপুর অভিযোগ করেছে, তারা ‘অসম বণ্টন নীতির শিকার’।

বেহুলাবাংলার কর্ণধার চন্দন চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “২০১৭ সালে বইমেলায় ৮৩টি নতুন বই প্রকাশ করে আসা বেহুলা বাংলা এবার দেড় শতাধিক বই নিয়ে মেলায় অংশ নিচ্ছে। এবার আমাদের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মাত্র ১ ইউনিটের স্টল। এত বই তো ১ ইউনিটের স্টলে সাজিয়ে রাখা সম্ভব না। আমরা ইউনিট বৃদ্ধির আবেদন জানিয়েছি।”

অন্যদিকে চট্টগ্রামের প্রকাশনী খড়িমাটি ও ছোটদের প্রকাশনী টাপুরটুপুর অর্ধ শতাধিক বই প্রকাশের পরও স্টল বরাদ্দ না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছে, “গ্রন্থমেলা কমিটি এবার স্টল বরাদ্দের ক্ষেত্রে বৈষম্য করছে।”

প্রকাশকদের এক পক্ষের অভিযোগ নিয়ে পরে কথা হয় বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ও অন্যপ্রকাশের কর্ণধার মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে।

প্যাভিলিয়নের আয়তন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ‘চূড়ান্ত হয়নি’ জানিয়ে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা যারা আগে থেকেই প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ পাই, তারা বলেছিলাম প্যাভিলিয়নের আয়তন বৃদ্ধি করা হোক। বাংলা একাডেমিও কিন্তু আয়তন বাড়ানোর কথা বলেছিল। আয়তন বাড়ানো হবে কি না তা সিদ্ধান্ত নেবে গ্রন্থমেলা কমিটি। আমি এ ব্যাপারে কিছু জানি না।”

মাজহারুল ইসলাম নিজেও এবারের গ্রন্থমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য।

স্টল বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে  গ্রন্থমেলা কমিটির সদস্য সচিব জালাল আহমেদ বলেন, “নীতিমালা অনুযায়ী যোগ্যদের আমরা স্টল বরাদ্দ দিচ্ছি। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, এবার নীতিমালার ব্যত্যয় হয়নি।  যারা যোগ্য দাবিদার, তাদের সেভাবেই স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।”

আগামী সপ্তাহে গ্রন্থমেলা পরিচালনা কমিটি স্টল বরাদ্দের বিষয়টি চূড়ান্ত করবে বলেও জানান তিনি।

এবার গ্রন্থমেলার স্টল ভাড়াও বাড়ানো হয়েছে। গতবারের তুলনায় এবার প্যাভিলিয়নের ভাড়া বেড়েছে ২০ শতাংশ, চার ইউনিট ১০ শতাংশ এবং তিন ইউনিট ৫ শতাংশ হারে। তবে এক ও দুই ইউনিটের স্টলের ক্ষেত্রে ভাড়া বাড়েনি।

প্রকাশনীর মালিকরা স্টল ভাড়া বাড়ানোয় ক্ষুব্ধ। ২১ জানুয়ারি স্টল বরাদ্দের ডিজিটাল লটারি অনুষ্ঠানের দিনে তারা এ নিয়ে ক্ষোভ জানাবেন বলেও জানান অনেক প্রকাশক।

ফাইল ছবি

 

‘নতুনভাবে’ আসছে নিরাপদ ইভেন্টস

দ্বিতীয়বারের মতো গ্রন্থমেলার নান্দনিক দিকটির দায়িত্ব পাচ্ছে অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চনের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্ম নিরাপদ ইভেন্টস।

গতবারের গ্রন্থমেলায় মেলার নান্দনিকতার ত্রুটি নিয়ে অভিযোগের আঙুল উঠে নিরাপদের দিকে। এবার সেসব ত্রুটি সামলে নিয়ে ডিজাইনারদের নিয়ে মেলার নতুন নকশা প্রণয়ন করতে বসেছেন ইলিয়াস কাঞ্চন।

বৃহস্পতিবার তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এবার মেলার নান্দনিক দিকটি নতুনভাবে সাজাবে নিরাপদ। এবার নতুনভাবে আসছে নিরাপদ।”

গতবার মেলায় নতুন গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন মঞ্চ, মেলায় প্রবেশপথের তোরণ ও তার পাশে এলইডি স্ক্রিন নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে নিরাপদ।

এবার সেসব ত্রুটি সংশোধন করে মেলাকে আরো বেশি নান্দনিক করে তোলার পাশাপাশি বেশকটি প্রতিষ্ঠানের স্পন্সর পাচ্ছেন বলে জানান ইলিয়াস কাঞ্চন।

তিনি বলেন, “এবার একজন স্পন্সর পেয়ে গেছি ইতোমধ্যে।  আরো বেশকটি প্রতিষ্ঠান আমাদের স্পন্সর করবে। এবার নান্দনিকতার দিক নিয়ে ত্রুটি রাখতে চাই না আমরা।”

ফাইল ছবি

 

‘বিশেষ’ অর্থ বরাদ্দ চেয়েছে বাংলা একাডেমি

এবার গ্রন্থমেলার পরিসর বাড়ছে, বাড়ছে স্টল সংখ্যা; পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সার্বিক খরচও।

সার্বিক দিক বিবেচনা করে এ বছর মেলা শুরুর  আগে মেলা পরিচালনার জন্য সরকারের কাছে ‘বিশেষ’ অর্থ বরাদ্দ চেয়েছে আয়োজক বাংলা একাডেমি।

জালাল আহমেদ জানান, মেলা পরিচালনার জন্য ২ কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ চেয়েছে বাংলা একাডেমি।
অন্যন্যবারের মতো এবারও মেলা চলবে বিকাল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত।

সে সঙ্গে প্রকাশনার স্টলগুলোকে এবার অগ্নিবীমার পাশাপাশি স্লাইক্লোন ও দাঙ্গা-হাঙ্গামাজনিত সৃষ্ট সমস্যাও বীমার আওতায় আনা হচ্ছে।

মেলায় কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকছে। এবারও মেলা প্রাঙ্গণ থেকে টিএসসি ও শামসুন্নাহার হল হয়ে শাহবাগ মোড় এবং অন্যদিকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার আওতায় থাকবে। একই সঙ্গে বাংলা একাডেমির অভ্যন্তরে ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসানো হবে আর্চওয়ে।