র্যাব বলছে, নিহত ওই তিন তরুণ নিষিদ্ধ জঙ্গি দল জেএমবির সদস্য। তারা ভুয়া পরিচয়পত্র ব্যবহার করে দিন দশেক আগে ওই বাসায় উঠেছিল।
অভিযান শুরুর পর তারা রান্নাঘরের চুলার ওপর গ্রেনেড রেখে গ্যাস ছেড়ে দিয়ে বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটানোর চেষ্টা করেছিল বলেও র্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
এ বাহিনীর গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান জানান, ওই বাসায় তিনটি ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি), তিনটি সুইসাইড ভেস্ট, ১৪টি ডেটোনেটর, চারটি পাওয়ার জেল ও দুটি পিস্তল পেয়েছেন তারা।
তিনি বলেন, পুরনো এমপি হোস্টেলের পেছনে রুবি ভিলা নামের ওই ছয় তলা বাড়ির পঞ্চম তলায় অবস্থান নিয়ে জঙ্গিরা নাশকতার পরিকল্পনা করছে বলে গোয়েন্দা তথ্য ছিল তাদের কাছে।
এর ভিত্তিতেই বৃহস্পতিবার রাত ২টার দিকে ভবনটি ঘিরে ফেলে র্যাব। কিন্তু ভবনের নিচের লোহার ফটক বন্ধ থাকায় তা ভেঙে র্যাব সদস্যরা ভেতরে ঢোকেন।
সকালে র্যাবের বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল ভেতরে ঢুকে কাজ শুরু করে। পরে ১০টার দিকে র্যাব মহাপরিচালক বেনজীর ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের জানান, ভেতরে ২৫ থেকে ২৭ বছর বয়সী তিন তরুণের লাশ পেয়েছেন তারা।
সিআইডির ক্রাইম সিন ও ফরেনসিক ইউনিটের কাজ শেষে বিকালে তিনটি বডিব্যাগে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালের মর্গে।
মুফতি মাহমুদ খান তখন অভিযান শেষ হওয়ার কথা জানিয়ে সাংবাদিকদের বলন, নিহতদের নাম-পরিচয় তারা নিশ্চিত হতে পারেননি। তবে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তারা জেনেছেন, ওই তিন তরুণ জেএমবি সদস্য।
মুফতি মাহমুদ বলেন, জঙ্গিদের বিষয়ে তথ্য পাওয়ার জন্য ওই বাড়ির কেয়ারটেকার রুবেলকে তারা জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন।
“সে বলেছে, জাহিদ নামের এক যুবক গত ২৮ ডিসেম্বর এসে পাঁচ তলার একটি কক্ষ ভাড়া নিতে চায়। জাহিদ তাকে বলেছিল, সে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করে। দুই ভাইকে নিয়ে ওই বাসায় সে থাকবে।”
এরপর ৪ জানুয়ারি ‘জাহিদ’ পরিচয় দেওয়া সেই যুবক বাসায় ওঠেন। বাকি দুজন ওঠেন ৮ জানুয়ারি।
পঞ্চম তলার ওই ফ্ল্যাটের একটি কক্ষে তারা তিনজন থাকতেন। বাকি দুটি কক্ষে আগে থেকেই আরও চারজন থাকতেন।
মুফতি মাহমুদ বলেন, ওই ঘরে জাহিদের ছবিসহ দুটি জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়া গেছে। তার একটিতে নামের জায়গায় জাহিদ লেখা থাকলেও অন্যটিতে লেখা রয়েছে সজীব।
“জাহিদ খুব ভোরে বাড়ি থেকে বের হয়ে অনেক রাতে ফিরত। অন্য দুজন কখন কি করত সে বিষয়ে কেউ কিছু বলতে পারেনি।”
অভিযানের শুরুতেই বাড়ির গ্যাস লাইন বন্ধ করে দিয়েছিল র্যাব। গোলাগুলি থামার পর পঞ্চম তলার ওই ফ্ল্যাটের দুটি কক্ষ থেকে চারজনকে সরিয়ে নেওয়া হয়। সেই সঙ্গে অন্যান্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের নিয়ে যাওয়া হয় দোতলায় বাড়িওয়ালার বাসায়।
সেখানে তাদের সঙ্গে কথা বলে জঙ্গিদের পরিচয় জানার চেষ্টা করেন র্যাব কর্মকর্তারা। মুফতি মাহমুদ বলেন, জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হলে সবাইকে যার যার বাসায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে।
অভিযানে থাকা এক র্যাব সদস্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, কেয়াটেকার রুবেলের সঙ্গে বাড়িওয়ালার ছেলেকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে।
ছয় তলা ওই বাড়ির মালিক শাহ মোহাম্মদ সাব্বির হোসেন (৫৫) বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একজন ফ্লাইট পারসার। তার বাড়িতে যখন অভিযান চলছিল, তখন তিনি কোনো একটি ফ্লাইটে ডিউটিতে ছিলেন।
মুতি মাহমুদ জানান, জঙ্গিদের অবস্থানের খবরে ২০১৬ সালের ১৪ অগাস্ট এবং ২০১৩ সালে দুই দফা এ বাড়িতে অভিযান চালিয়েছিল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
পশ্চিম নাখালপাড়ার ৬০ নম্বর বাড়ির মালিক মো. নাসির হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, রুবি ভিলার মালিকের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ। ১৫ বছর আগে দুই কাঠা জমির উপর ওই বাড়ি তিনি নির্মাণ করেন।
“ওই বাড়ি তার স্ত্রীর নামে, তাদের একজন ছেলে আছে। তারা এলাকার মানুষের সাথে খুব একটা মেশে না। তবে সাব্বিরের আচার-আচরণে আমাদের কখনও কোনো সন্দেহ হয়নি।”
অবশ্য ওই বাড়ির পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলায় মেস ভাড়া দেওয়া নিয়ে এলাকার অনেকের আপত্তি ছিল বলে জানান নাসির।
তিনি বলেন, ২০১৬ সালের ১৪ অগাস্ট রুবি ভিলায় অভিযান চালিয়ে জঙ্গি সন্দেহে ১০/১২ জনকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল র্যাব-পুলিশ।
বৃহস্পতিবার রাতের অভিযানের বিবরণ দিয়ে নাসির বলেন, “গভীর রাতে বিকট শব্দ শুনে নিচে নেমে আসি। র্যাব সদস্যরা আমাকে সেখান থেকে চলে যাওয়ার কথা বলে। তারা জানায়, ওই বাড়িতে জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পাওয়া গেছে।”
ফজরের নামাজের আগ পর্যন্ত থেমে থেমে গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়ার কথা জানান নাসির ও আশপাশের বাড়ির বাসিন্দারা।
রুবি ভিলার পেছনের বাড়িতে বসবাসকারী বদরুল (৩৫) বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাতে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে ঘুম বেঙে যায়। ওই সময় বাইরে দৌড়াদৌড়ির শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। থেমে থেমে গুলির শব্দ হাচ্ছিল।”
সকালে ঘটনাস্থল থেকে কিছুটা দূরে ভিড় করে থাকা জনতার মধ্যে কামাল হোসেন নামের এক প্রৌঢ় জানান, তার ছেলে পারভেজ হোসেন পরাগ ওই বাসার ষষ্ঠ তলায় একটি মেসে থাকে। ভোর ৪টার দিকে পরাগ তার মাকে ফোন করে জানায়, বাসার দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, বাইরে প্রচণ্ড গোলাগুলি হচ্ছে।
ওই খবর পেয়েই গাজীপুর থেকে রওনা হয়ে সকালে নাখালপাড়ায় চলে এলেও ছেলের সঙ্গে দেখা হয়নি কামালের।
মুফতি মাহমুদ বলেন, একটি বিস্ফোরক রাখা ছিল গ্যাস বার্নারের ওপর। তাতে তাদের মনে হয়েছে, চুলার ওপর রেখে আগুন জ্বালিয়ে বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটাতে চেয়েছিল জঙ্গিরা। কিন্তু অভিযানের শুরুতেই র্যাব ওই বাড়ির গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেওয়ায় তা আর সম্ভব হয়নি।
জঙ্গিরা গ্যাস ছেড়ে দিয়ে ওইভাবে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারলে পুরো ভবনের বাসিন্দাদের বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারত বলে জানান তিনি।
সকালে বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দলের কাজ শেষে র্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ভেতরে যে তিনজনের লাশ পাওয়া গেছে, তাদের একজনের গায়ে সুইসাইড ভেস্ট ছিল। আর একজনের মৃতদেহের নিচে ছিল একটি আইইডি।
এছাড়া রান্নাঘরে গ্যাসের চুলার ওপর ছিল আরেকটি আইইডি। তা দেখে তাদের মনে হয়েছে, গ্যাস ছেড়ে দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটানোর চেষ্টা করেছিল জঙ্গিরা। কিন্তু র্যাব আগেই গ্যাস লাইন বন্ধ করে দেওয়ায় তা আর সম্ভব হয়নি।
মুফতি মাহমুদ খান বলেন, জঙ্গিরা ওইভাবে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারলে পুরো ভবনের বাসিন্দাদের বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারত।