প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিদ্যুৎ খাতে অনেকটা অগ্রগতি হলেও অবকাঠামোয় আগের মেয়াদে নেওয়া বড় দুই প্রকল্প পদ্মা সেতু ও ঢাকা মেট্রোরেলই এখনও উল্লেখযোগ্য জায়গায় পৌঁছেনি। দ্বিতীয় পদ্মা ও যমুনা সেতু বাস্তবায়নের কথা থাকলেও তাতে এখনও হাতই পড়েনি।
ঢাকা ঘিরে সার্কুলার রেলপথ নির্মাণেরও কোনো খবর নেই। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পর ঢাকা-মংলা এবং ঢাকা-বঙ্গবন্ধু সেতুর মহাসড়কও চার লেইন করার প্রতিশ্রুতি ছিল। তবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চার লেইনের কাজই এখনও শেষ হয়নি।
দুই দশক আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি করা আওয়ামী লীগ এবার এই চুক্তির অবশিষ্ট অঙ্গীকার ও ধারা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিলেও সেখানে কোনো অগ্রগতি নেই বলে অভিযোগ পাহাড়িদের।
সংবাদপত্রকে শিল্প ঘোষণার পাশাপাশি অনলাইন পত্রিকা ও সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য নীতিমালা প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।
নয় বছর আগে ১০ টাকায় চাল খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানতে হিমশিম খাচ্ছে। ২০১০ সালের ধসের ধাক্কা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি পুঁজিবাজার। খেলাপি ঋণ ও ঋণের নামে অর্থ আত্মসাতে ব্যাংক খাতে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা।
বিএনপির বর্জনের মধ্যে অনুষ্ঠিত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ওই নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, রাজনৈতিক সমঝোতা হলে সংসদ ভেঙে মধ্যবর্তী নির্বাচন দেওয়া যেতে পারে। তবে চার বছরে বিরোধীদের সঙ্গে সমঝোতা তো হয়নি বরং আগামী নির্বাচন নিয়ে সহিংসতার ঝুঁকি উঁকি দিচ্ছে জনমনে।
তারা বলছেন, চার বছরে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুতির কাঙ্ক্ষিত সফলতা আসেনি। সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে শহরে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এর ফল পাচ্ছে না।
সরকারের শেষ বছরে তাড়াহুড়ো থাকায় বড় অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি তেমনটা হবে না বলেই মনে করছেন তারা। তাদের এই শঙ্কার ভিত্তি পাওয়া যায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে।
গত রোববার ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের বৈঠকে তিনি বলেন, “মেট্রোরেল আসবে সেটা আরও সময়সাপেক্ষ। সামনে ইলেকশন, বাস্তবভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই মুহূর্তে কী কী করলে ঢাকা শহরে যানজট সহনীয় মাত্রায় রাখা যাবে সে কাজগুলো আমরা কিছু কিছু করে করতে পারি।”
“শেষ বছরের এসে যতই তাড়াহুড়ো করুন, যতই তারা সিরিয়াসলি নেন না কেন-সময় অত্যন্ত সংকীর্ণ।”
সরকারের চার বছরপূর্তির আগের দিন বৃহস্পতিবার জাতীয় উন্নয়ন মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন “আমাদের উন্নয়নটা হচ্ছে সার্বিকভাবে সকল জনগণের জন্য। আর বিশেষ করে আমাদের গ্রামের মানুষের জন্য। আমরা প্রতিটি গ্রামকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে চাই; চলাফেরার জন্য রাস্তাঘাট উন্নত করতে চাই।”
তবে অধ্যাপক মিজানের মতে, উন্নয়ন যেটা হয়েছে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী তার সুফল সেভাবে পাচ্ছে না।
“উন্নয়নের ভারসাম্য নেই, বৈষম্যমূলক উন্নয়ন এটা। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এটাই করে।”
এ বিষয়ে মিজানুর রহমান শেলী বলেন, “যেসব অর্জনের কথা সরকার বলছে এবং মানুষের কাছে দৃশ্যমান হচ্ছে-সেগুলো তো আমাদের কাছে স্পষ্ট। মাথাপিছু আয়, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, রিজার্ভের পরিমাণ বেড়েছে; বড় বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এসব উন্নয়নের সঙ্গে একটা অভিযোগ- সরকারের অনেকে প্রকারান্তরে স্বীকার করেন এরমধ্যে ভারসাম্যমূলক উন্নয়ন তেমন হয়নি। বৈষম্য আরও প্রকট হয়েছে।
“উপরের মানুষগুলোই ধন-দৌলতে বিত্তবান হয়ে উঠছেন, তাদের তুলনায় সাধারণ মানুষ যারা দারিদ্র্য সীমার নিচে রয়েছেন ২৫-৩০ শতাংশ, তাদের উন্নয়ন হয়নি। দুঃখের কথা- এ সরকারের, ক্ষমতাসীন দলের এটা একটা বিরাট ব্যর্থতা।”
এ বিষয়ে সরকার সচেতন হয়ে কাজ করলেও বছরখানেকের মধ্যে কতটুকু উন্নয়ন করা সম্ভব তা বলাও দুরূহ বলে মন্তব্য করেন এরশাদ সরকারের এই মন্ত্রী।
তিনি বলেন, “এ বছরটা হবে নির্বাচনের বছর। এ সময় মানুষের মনোযোগ থাকবে অন্যদিকে। তাড়াহুড়ো করে সুদূরপ্রসারী উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলোকে তাৎপর্যময় করা সম্ভব হয়ে উঠবে না।”
পদ্মা সেতু নিয়ে মিজানুর রহমান শেলী বলেন, “পদ্মা সেতুর একটা মাত্র পাইলিং দেখা যাচ্ছে। এ সেতু করতেই আরও দুবছর লাগবে। দ্বিতীয় পদ্মা সেতুর কথা স্বপ্নে দেখা যায়, বাস্তবায়নের কথা আদিখ্যেতা। প্রথমটা শেষ করা গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় যমুনা সেতুর অর্থায়ন নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে…।”
ঢাকা-চট্টগ্রামসহ মহাসড়ক চার লেন করার কাজও খুব দ্রুত শেষ করা দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।
“মেয়াদের শেষ বছরে এসে সব বড় প্রকল্প শেষ করা সম্ভব না, শুরু করা সম্ভব। ভালো কাজ একবার শুরু করলে তা চলতে থাকবে।”
তার মতে, জঙ্গি দমন ও যুদ্ধাপরাধের বিচারে সরকারের অসামান্য সফলতা রয়েছে। তবে পুলিশি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও আদর্শগত বিষয় নির্মূলে সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে এগোতে হবে।
চার বছরের মূল্যায়নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু ইউসুফ বলেন, “অনেকগুলো কাজ হাতে নিয়েছে, মেগা প্রজেক্টও রয়েছে অনেক। অবকাঠামোগত দিক দিয়ে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। বিশেষ করে কিছু কিছু দৃশ্যমান হলেও কমপ্লিট সাইকেলটা শেষ হয়নি।
“সার্বিকভাবে বলতে গেলে, সরকার অনেক কাজ হাতে নিয়েছে; ভিজিবলও হচ্ছে। শহরে উন্নয়ন হচ্ছে; কিন্তু গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। জঙ্গি দমনসহ নানা ক্ষেত্রে সফলতা রয়েছে। কিন্তু অবকাঠামোগত উন্নয়নে মেনটেনেন্সের তদারকি খুব দরকার। শহরের বাইরে গ্রামে উন্নয়নের সুফল পৌঁছছে না, হয়ত এ মেয়াদের শেষ বছরে এ বিষয়ে জোর দেওয়া হবে।”
শেষ বছরে বড় অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে সরকার আরও উদ্যোগী না হলে ফলপ্রসূ কিছু হবে না বলে মনে করেন অর্থনীতির অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ।
ইকোনমিক রিচার্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলছেন, “২০১৮ সালে রাজনীতি যে কোথায় দাঁড়াবে সে সম্পর্কে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মনে সংশয় রয়েছে। এ অবস্থায় বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের ধারাবাহিক মন্দা পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে মনে হয় না।”
আওয়ামী লীগ সরকার আরেকবার ক্ষমতায় আসতে পারলে অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফল পাওয়া যাবে বলে মনে করেন মিজানুর রহমান শেলী ও অধ্যাপক ইউসুফ।
‘বড় ব্যর্থতা রাজনীতিতে’
রাজনৈতিক সমঝোতা হলে সংসদ ভেঙে দিয়ে মধ্যবর্তী নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে ভোটে জিতে সরকার গঠনের পর সমঝোতাও হয়নি, ভোটের প্রশ্নও আর হয়নি।
এখন একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি নির্দলীয় সরকারের দাবি জানালেও তাতে সাড়া নেই আওয়ামী লীগের। সংবিধান অনুযায়ী শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়ে দৃঢ় অবস্থান জানিয়ে আসছেন দলটির নেতারা।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারাকেই সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হিসেবে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মিজানুর রহমান শেলী।
“সেজন্যে গণতন্ত্র অনিয়ন্ত্রিত, পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেনি; সংশয়, সন্দেহ, সহিংসতার ভয় থেকেই যায়। ভোটের এ বছরে এ প্রবণতা যদি অক্ষুন্ন থাকে তাহলে দেখা যাবে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে।”