মন্ত্রিসভায় রদবদল

নতুন তিন মন্ত্রী ও এক প্রতিমন্ত্রীর মধ্যে দপ্তর বণ্টনের পাশাপাশি পুরনো চারজনের দায়িত্ব বদলে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Jan 2018, 08:56 AM
Updated : 3 Jan 2018, 08:56 AM

সরকারের মেয়াদের চার বছরের মাথায় এসে বুধবার মন্ত্রিসভার এই রদবদলে পুরনো যে তিন মন্ত্রীর দপ্তর বদলেছে, তাদের সবাই সরকারের শরিক দলের নেতা।

এ সরকারের শুরু থেকে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। তাকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বে পাঠিয়ে বিমান ও পর্যটনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে নতুন মন্ত্রী হওয়া লক্ষ্মীপুরের এমপি এ কে এম শাহজাহান কামালকে।

২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি এ সরকারের মন্ত্রিসভা গঠনের সময় জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে পরিবেশ ও বন এবং জাতীয় পার্টির (এরশাদের) প্রেসিডিয়াম সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এবার তাদের দুজনের দায়িত্ব পাল্টে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ পরিবেশে এবং মঞ্জু পানিসম্পদের দায়িত্বে এসেছেন।

মন্ত্রী হিসেবে নতুন শপথ নেওয়া মোস্তাফা জব্বার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের এই উদ্যোক্তার এ মন্ত্রণালয় পাওয়া অনেকটা অনুমিতই ছিল। হজ নিয়ে মন্তব্যের কারণে ২০১৪ সালের অক্টোবরে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী মন্ত্রিত্ব হারানোর পর খালিই ছিল এ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী পদটি।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে আসা নারায়ন চন্দ্র চন্দ পদোন্নতি পেয়ে একই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হয়েছেন। এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করে আসা মুহাম্মদ ছায়েদুল হক মারা গেলে গত মাসের মাঝামাঝি সময়ে মন্ত্রী পদটি শূন্য হয়।

সরকারের দেড় বছরের মাথায় ২০১৫ সালের ১৪ জুলাই ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন তারানা হালিম। তাকে এবার পাঠানো হয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়ে।

আর নতুন প্রতিমন্ত্রী কাজী কেরামত আলী পেয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের দায়িত্ব। রাজবাড়ীর এই এমপি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য এবং সরকারি প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিত কমিটি সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী এবং প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিন মারা গেলে ২০১৬ সালের ১৯ জুন প্রতিমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদকে সমাজকল্যাণে পাঠানো হয়।

রাশেদ খান মেনন এ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হওয়ায় নুরুজ্জামানের হাতে আর মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব রাখা হয়নি। এখন তিনি শুধু প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকবেন।

 

যেসব মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী নেই- পদাধিকারবালে প্রধানমন্ত্রী সেসব মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বে থাকেন। তবে প্রধানমন্ত্রী যদি কোনো প্রতিমন্ত্রীকে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন তবে তার হাতেই থাকে পুরো দপ্তর। বর্তমানে শ্রম, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় চলছে প্রতিমন্ত্রী দিয়ে।

ভোটের ঠিক এক বছর আগে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কাছ থেকে মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে শপথ নেন নারায়ন চন্দ্র চন্দ, মোস্তাফা জব্বার, শাহজাহান কামাল ও কেরামত আলী।

বুধবার দুপুরে মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম নতুনদের দপ্তর বণ্টন এবং পুরনোদের রদবদলের তথ্য সাংবাদিকদের জানান। পরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত আদেশ জারি করা হয়।

রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিচ্ছেন (বাঁ থেকে) মোস্তাফা জব্বার, শাহজাহান কামাল, নারায়ন চন্দ্র চন্দ- ছবি: বঙ্গভবন

রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিচ্ছেন কাজী কেরামত আলী- ছবি: বঙ্গভবন

পরিবর্তন কেন?

সরকারের মেয়াদের এক বছর বাকি থাকতে মন্ত্রিসভার এই সম্প্রসারণকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নে তিনি বলেন, “নতুন তিনজনকে নিয়েছেন, আমার মনে হয় ভালো হয়েছে।”

মন্ত্রিসভায় যে জ্যেষ্ঠ তিনজন সদস্যের দপ্তর বদল হয়েছে তারা সরকারের শরিক দলের নেতা। নির্বাচনের বছরে এসে জোট শরিকদের একটু চাপে রাখতেই তাদের দপ্তর বদল করা হয়েছে বলে বিভিন্ন মহলে আলাচনা চলছে।

এ বিষয়ে শফিক আহমেদ বলেন, “প্রধানমন্ত্রী প্রয়োজন বোধ করায় রদবদল করেছেন। এটাতে অন্য কোনো কিছু আছে বলে আমি মনে করি না।”

তথ্য মন্ত্রণালয়ে তারানা হালিমকে পাঠিয়ে প্রধানমন্ত্রী ওই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর একক কর্তৃত্ব কমিয়ে আনলেন কি না- সে প্রশ্নও তুলেছেন কেউ কেউ।

তবে এরশাদের জাতীয় পার্টি বা জাসদের কোনো নেতা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

আর রাশেদ খান মেননের দপ্তর বদলের পেছনে কোনো ব্যর্থতা কাজ করেছে কি না- সে প্রশ্ন তার কাছেই করেছিলেন সাংবাদিকরা।

জবাবে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি মেনন বলেছেন, “বছরের প্রথমভাগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার যে সম্প্রসারণ করলেন ও পরিবর্তন সাধন করলেন, আমার মনে হয় স্বাভাবিকভাবে প্রশাসনে গতিশীলতা আনার জন্য করলেন। এটিই হচ্ছে শেষ বছর আমাদের সরকারের। সুতরাং তিনি চেয়েছেন শেষ বছরের কাজের সমন্বয় আরও ভালোভাবে যেন হয়।”

মেনন বৃহস্পতিবার থেকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নতুন দপ্তরে বসবেন। আর মেননের পুরনো অফিসে বসবেন নতুন মন্ত্রী শাহজাহান কামাল। 

আর দপ্তর বদল হওয়ায় একে অন্যের মন্ত্রণালয়ে বসবেন আনিসুল ইসমাল মাহমুদ ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জু।

মন্ত্রী হিসেবে পদোন্নতি পাওয়া নারায়ণ চন্দ্রের জন্য বুধবারই নতুন কক্ষ প্রস্তুত করেছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

টেলিকম-আইসিটির নতুন মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং তথ্যপ্রযু্ক্তি বিভাগের দুই অফিসেই বসবেন বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।

তথ্য মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে তারানা হালিমের জন্য আলাদা কক্ষের ব্যবস্থা করতে হবে। বুধবার থেকেই মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সেই তৎপরতা শুরু করেছেন।

আর কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে নিয়োগ পাওয়া কেরামত আলীর দপ্তর পরিবহন পুল ভবনে হবে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

কারণ হিসেবে তারা বলছেন, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর অফিস পরিবহন পুল ভবনের একটি ফ্লোরে। তাই নতুন প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরও সেখানে করা হবে।

সচিবালয় লাগোয়া ওই ভবনে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়েরও অফিস।

ফাইল ছবি

যত রদবদল

২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি ৪৯ সদস্যের মন্ত্রিসভা গঠন করে এ সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছিল; যার মধ্যে ২৯ জন মন্ত্রী, ১৭ জন প্রতিমন্ত্রী ও দুইজন উপমন্ত্রী।

এর দেড় মাসের মাথায় এ এইচ মাহমুদ আলী মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন, মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম হিরু পান প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব। আর হজ নিয়ে মন্তব্যের জন্য অক্টোবরে মন্ত্রিত্ব খোয়ান লতিফ সিদ্দিকী।

২০১৫ সালের ৯ জুলাই আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করা হয়। প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে দেওয়া হয় স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব।

এর পরের সপ্তাহে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল ইসলাম বিএসসিকে মন্ত্রী এবং তারানা হালিম ও নুরুজ্জামান আহমেদকে প্রতিমন্ত্রী করা হয়। ওই দিন মন্ত্রী হিসেবে পদোন্নতি পান আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল এবং ইয়াফেস ওসমান। আর ১৬ জুলাই সৈয়দ আশরাফকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ওই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিন ভারতের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ২০১৬ সালের ১১ মে। এরপর ২০১৬ সালের ১৯ জুন খাদ্য থেকে প্রতিমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদকে পাঠানো হয় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে।

গত বছরের শেষ দিকে এসে ১৬ ডিসেম্বর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী ছায়েদুল হকের মৃত্যু হয়।

নতুন চারজনকে নিয়ে শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার সদস্য সংখ্যা এখন ৫৩ জনে দাঁড়িয়েছ। তাদের মধ্যে ৩৩ জন মন্ত্রী, ১৭ জন প্রতিমন্ত্রী এবং দুইজন উপমন্ত্রী।

এছাড়া মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের দায়িত্বে আছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে আছেন আরও পাঁচজন।