২০১৭ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে সাড়ে ৮ শতাংশ: ক্যাব

সদ্য বিদায়ী ২০১৭ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় ৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাব।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Jan 2018, 07:58 AM
Updated : 2 Jan 2018, 05:38 PM

মঙ্গলবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে ২০১৭ সালে জীবনযাত্রার ব্যয়ের উপর বার্ষিক প্রতিবেদন তুলে ধরেন ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান।

এই পরিস্থিতিতে বাজার ঠিক রাখতে আলাদা মন্ত্রণালয় গঠনের প্রস্তাবও দেন তিনি।

রাজধানীর ১৫টি খুচরা বাজার ও বিভিন্ন সেবা খাতের মধ্য থেকে ১৪০টি খাদ্যপণ্য, ২২টি নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রী ও ১৪টি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের তথ্য পর্যালোচনা করে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে ক্যাব।

গোলাম রহমান বলেন, “গত বছর পণ্য ও সেবা সার্ভিসের মূল্য বেড়েছে ৭ দশমিক ১৭ শতাংশ, যা আগের বছর ছিল ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ।

“আগের ২০১৬ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় ৬ দশমিক ৪৭ বাড়লেও এবার সব মিলিয়ে ব্যয় বেড়েছে ৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ।”

তবে এই হিসাবে শিক্ষা, চিকিৎসা এবং প্রকৃত যাতায়াত ব্যয় পর্যালোচনায় রাখা হয়নি।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে সব ধরনের চালের গড়মূল্য বেড়েছে ২০ দশমিক ৪০ শতাংশ, তুলনামূলকভাবে মোটা চালের দাম বেশি বেড়েছে।

এছাড়া গত বছর সবচেয়ে বেশি বেড়েছে পেঁয়াজের দাম, দেশি পেঁয়াজের দাম ৪০ দশমিক ৯৯ শতাংশ এবং আমদানি করা পেঁয়াজের দাম ৫৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ বেড়েছে।

ক্যাবের সভাপতি বলেন, “ব্যয় বৃদ্ধির অভিঘাতে নিম্ন আয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। ব্যয় কমানোর কোনো তৎপরতা সরকারের পক্ষ থেকে দেখা যাচ্ছে না। উন্নয়ন হচ্ছে তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু এর সুফল নিম্ন আয়ের মানুষ পাচ্ছে না। আয় বেড়েছে গুটিকয়েক মানুষের, ব্যয় বেড়েছে প্রায় সবারই।”

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম ও স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন।

চালের মজুদ বাড়ানোর দাবি

চালের দাম নিয়ন্ত্রণে সঠিক সময়ে সরকারি গুদামে মজুদ বাড়ানোর পরামর্শ দেন ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান।

তিনি বলেন, “সরকারি গুদামে খাদ্যশস্যের ধারণ ক্ষমতা ১৬/১৭ লাখ টন। নতুন বছরে সরকারের গুদামে চালের মজুদ ১০ থেকে ১২ লাখ টনে উন্নীত হলে এবং সরকারের সেইফটি নেট প্রোগ্রামগুলোতে চাল বিতরণ বৃদ্ধি পেলে মূল্য স্থিতিশীল ও সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসবে।”

কৃষককে সুলভ মূল্যে উন্নত বীজ, সার, পানি ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ সরবরাহের পাশাপাশি ঋণ সুবিধা এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা বাড়ানোর সুপারিশ করেন তিনি। কৃষকের উৎপাদিত ফসলের লাভজনক মূল্য নিশ্চিত করার সুপারিশও তিনি করেন।

সরকারের চাল সংগ্রহ কাজে অনিয়মের কারণে দাম বাড়ে এবং কৃষকের লাভ হওয়ার পরিবর্তে মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা লাভবান হয় বলে মনে করেন গোলাম রহমান।

তিনি বলেন, “সাধারণত ধান কাটা শুরুর আগেই সরকার ধান-চালের সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ও সংগ্রহ মূল্য স্থির করে। তবে নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ধান চাল সংগ্রহ প্রতিবছরই বিলম্বে শুরু হয়। ফলে বাধ্য হয়ে কৃষককে অন্যত্র ধান-চাল বিক্রি করে দিয়ে অর্থের প্রয়োজন মেটাতে হয়। এ প্রেক্ষাপটে কৃষক সরকারের ন্যায্য মূল্যে ধান-চাল সংগ্রহের সুফল থেকে বঞ্চিত হন, লাভবান হন মিল-মালিক ও মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়িক শ্রেণি।”

অনেক সময় রাজনৈতিক সুবিধাভোগী ব্যক্তিরা মৌসুম-ভিত্তিক কৃষক ও ব্যবসায়ী সেজে সরকার নির্ধারিত মূল্যের সুবিধা ভোগ করে বলেও দাবি করেন ক্যাব সভাপতি।

যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে

সংবাদ সম্মেলনে চাল-পেঁয়াজ ছাড়াও আরও কিছু নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির তথ্য তুলে ধরে ক্যাব।

ক্যাবের হিসাবে, শাক-সবজির দাম গড়ে বেড়েছে ২৪ দশমিক ২৮ শতাংশ। চিনি ও গুড়ে বেড়েছে ১২ দশমিক ৮ শতাংশ, লবণে বেড়েছে ১১ দশমিক ০৩ শতাংশ, ভোজ্য তেলে বেড়েছে ১০ দশমিক ৭৮ শতাংশ, চা পাতায় বেড়েছে ১০ দশমিক ৩২ শতাংশ এবং দেশি শাড়ি-কাপড়ে বেড়েছে ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ।

যেসব পণ্যের দাম কমেছে

ক্যাবের হিসাবে, দেশি মসুর ডালের দাম কমেছে ৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ, আমদানি করা মসুর ডালে কমেছে ১২ দশমিক ২৪ শতাংশ, ফার্মের ডিমে কমেছে ৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ, নারিকেল তেলে কমেছে ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ, আলুর দাম কমেছে গড়ে ৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ, রসুনে কমেছে ৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

ক্যাব সভাপতি বলেন, সার্বিকভাবে মাছের দাম বাড়লেও সরবরাহ বাড়ায় পাওয়ায় দেশে উৎপাদিত কই মাছের দাম কমেছে ৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ, ইলিশের দাম কমেছে ১ দশমিক ৪৯ শতাংশ।

ক্যাবের সুপারিশ

১২ থেকে ১৫টি  খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য চিহ্নিত করে সে সব পণ্যের সরবরাহ পরিস্থিতি সন্তোষজনক পর্যায়ে এবং মূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য ‘সরবরাহ ও মূল্য (সাপ্লাই অ্যান্ড প্রাইস)’ নামে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি পৃথক বিভাগ অথবা একটি স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করার সুপারিশ করেছে ক্যাব।

বিকল্প হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টার দায়িত্বে তার কার্যালয়ে একটি পৃথক উইং প্রতিষ্ঠাও বিবেচনা করা যেতে পারে, বলেন গোলাম রহমান।

ক্যাবের অন্য সুপারিশের মধ্যে রয়েছে

>> কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি সরকার নির্ধারিত মূল্যে ধান-চাল সংগ্রহ করা ও তাদের জন্য শস্য বীমা প্রবর্তন। >> বিশ্ববাজারে তেলের দামের সঙ্গে দেশে দাম সমন্বয় এবং বিদ্যুতের দাম কমানো।

>> বাড়ি ভাড়া আইন ১৯৯১ পরিমার্জন করে ভাড়াটিয়াদের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা, বাড়ি ভাড়া কমিশন গঠন করা।

>> যাত্রী দুর্ভোগ ও যানজট কমানোর লক্ষ্যে ঢাকায় বাস চলাচলের ক্ষেত্রে ফ্রাঞ্চাইজ প্রথা প্রবর্তন, র‌্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্প, মেট্রোরেল প্রকল্প সময়মতো বাস্তবায়ন করা। অ্যাপভিত্তিক যাত্রী পরিবহন আইনি কাঠামোয় আনা।

>> চিকিৎসকদের ফিসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরীক্ষার মূল্য নির্ধারণ, ওষুধের মান ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ; বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সুলভে মানসম্মত চিকিৎসা সেবা প্রদান নিশ্চিত।

>> টিসিবির মাধ্যমে ‘লোকসান-নয়, লাভ-নয়’ ভিত্তিতে মানসম্পন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্য নিয়মিত আমদানি ও বাজারজাতকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা।