২০১৭: আলোচনার কেন্দ্রে বিচারাঙ্গন

নানা সঙ্কট আর আলোচনা-সমালোচনায় ২০১৭ সালের প্রায় পুরোটা জুড়ে মানুষের মনোযোগ কেড়েছে দেশের সর্বোচ্চ বিচারাঙ্গন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Dec 2017, 02:19 PM
Updated : 31 Dec 2017, 02:33 PM

আলোচিত বিভিন্ন মামলার রায়, সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গনে ভাস্কর্য স্থাপন, অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাবিধির গেজেট প্রকাশ ও সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবার ছিল আলোচনায়।

তবে নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে দ্বন্দ্বের জেরে বছরের শেষ দিকে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার পদত্যাগের ঘটনা সাড়া ফেলে গোটা দেশে।

দেশের ইতিহাসে প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের ঘটনা এটিই প্রথম। এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক, পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি এখনও চলছে। প্রশ্ন, কৌতুহল রয়ে গেছে দেশের নাগরিকদের মধ্যেও।

লেডি জাস্টিস

বিদায়ী বছরে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রথম কার্যদিবসে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল। আপিল বিভাগের বিচারক ফজলুর রহমান ছানা ও হাই কোর্ট বিভাগের বিচারক জেএন দেবের মৃত্যুতে তাদের কর্মময় জীবন ও স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে ২ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টে এক দিনের ছুটি ঘোষণা করেছিলেন তখনকার প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। 

এরপর বছর জুড়ে বেশ সরগরম ছিল সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ। বছরের শুরুতেই সুপ্রিম কোর্টের মূল ভবনের সামনে ন্যায় বিচারের প্রতীক হিসেবে ‘লেডি জাস্টিস’ এর আদলে একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। কিন্তু এর বিরোধিতায় হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক সংগঠন, রাজনৈতিক দল আন্দোলনের ডাক দেয়।

পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ওই ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলার পক্ষে বলেন। আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে প্রধান বিচারপতি ভাস্কর্যটি সরিয়ে নিতে নির্দেশ দেন। ২৫ মে মধ্যরাতে সুপ্রিম কোর্টের মূল ভবনের সামনে থেকে সরিয়ে ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয় এনেক্স ভবনের সামনে।

আলোচিত মামলা

গত এক বছরে সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট ও আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি হয়েছে বেশ কিছু আলোচিত মামলার।

সাবেক ব্রিটিশ হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলার মামলায় রিভিউ খারিজ হওয়ায় হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নানসহ তিনজনের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয় এ বছর।

যুদ্ধাপরাধের মামলায় দণ্ডিত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর দণ্ড পুনর্বিবেচনার আবেদনও আপিল বিভাগ খারিজ করেছে।

হাই কোর্টেও এবার কিছু আলোচিত মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে।

>> ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যা মামলায় (https://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article1313080.bdnews) দুজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং জঙ্গি নেতা মুফতি জসীমউদ্দীন রাহমানীসহ অন্য ছয় আসামির বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডের সাজাই বহাল রেখেছে হাই কোর্ট।

>> পুরান ঢাকার দর্জি বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলায় বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আট আসামির মধ্যে দুই জনের সর্বোচ্চ সাজা বহাল রেখেছে হাই কোর্ট। চারজনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন ও দুইজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন পাওয়া দুইজন আপিল করে খালাস পেয়েছন।

>> পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানকে হত্যার ঘটনায় তাদের মেয়ে ঐশী রহমানের মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দিয়েছে হাই কোর্ট।

>> নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুনের মামলায় সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ও সাবেক তিন রাব কর্মকর্তাসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড হাই কোর্টে বহাল রাখা হয়েছ। বিচারকি আদালতে যে ২৬ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে ১১ জনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

>> পিলখানায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদর দপ্তরে বিদ্রোহের ঘটনায় সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যার দায়ে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রেখেছে হাই কোর্ট। ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে, তিন থেকে দশ বছরের সাজা হয়েছে ২২৮ জনের।

>> মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের মৃত্যুর ঘটনায় তার পরিবারকে চার কোটি ৬১ লাখ ৭৫ হাজার ৪৫২ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট। ক্ষতিপূরণের এই অর্থ পাবেন তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ, তাদের ছেলে নিষাদ মাসুদ এবং তারেকের মা নুরুন নাহার।

তবে বছরজুড়েই আলাচনার কেন্দ্রে ছিল অধস্তন আদালতের বিচারকদের শৃঙাখলাবিধি নিয়ে গেজেট প্রকাশ ও সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়। মূলত এ দুটি মামলাকে কেন্দ্র করেই বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ পায়।

ওই দুই মামলার মধ্যে একটিতে মিটমাট হয়ে গেলেও অন্যটির জের চলবে আগামী বছরও।   

বিচারপতি এসকে সিনহা (ফাইল ছবি)

ষোড়শ সংশোধনীর মামলা ও সঙ্কটের শুরু

উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব সংসদে পাস হয়, যা ষোড়শ সংশোধনী হিসেবে পরিচিত। সুপ্রিম কোর্টের নয়জন আইনজীবীর এক রিট আবেদনে হাই কোর্ট ২০১৬ সালের ৫ মে সংবিধানের ওই সংশোধনী ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে।

প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সাত বিচারকের আপিল বিভাগ গত ৩ জুলাই রাষ্ট্রপক্ষের আপিল খারিজ করে দিলে হাই কোর্টের রায়ই বহাল থাকে। ওই রায়ের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনে সুপ্রিম কোর্ট। সেইসঙ্গে বিচারকদের জন্য একটি আচরণবিধিও ঠিক করে দেওয়া হয়।

পরে সুপ্রিম কোর্ট গত ১ অগাস্ট ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করে। রায়ে বিচারপতি সিনহার ৪০০ পৃষ্ঠার পর্যবেক্ষণ দেখে শুরু হয় ব্যাপক বিতর্ক।

রায়ের পর্যবেক্ষণে সংসদ ও সরকার এবং জাতির জনককে খাটো করা হয়েছে অভিযোগ তুলে প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের দাবি তোলে আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা; ওই রায় এবং পর্যবেক্ষণ নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করেন।

অন্যদিকে ষোড়শ সংশোধন বাতিল করে বিচারপতি অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনার রায়কে স্বাগত জানায় বিএনপি।

ওই রায় নিয়ে ক্ষমতাসীনদের তোপের মুখে থাকা বিচারপতি সিনহা ৩৯ দিন ছুটি নিয়ে গত ১৩ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়ায় যান বড় মেয়ের কাছে। সেখান থেকে সিঙ্গাপুর হয়ে গত ১০ নভেম্বর কানাডায় ছোট মেয়ের বাড়িতে যান। পরদিন বঙ্গভবন থেকে জানানো হয়, প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন।

দেশ ছাড়ার সময় বিমানবন্দরে বিচারপতি এস কে সিনহা

এক হাজারের বেশি দিন দায়িত্ব পালনের পর মেয়াদ শেষের তিন মাস আগেই বিদায় নেন বিচারপতি সিনহা। আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞাকে প্রধান বিচারপতির দায়িত্বভার দেন রাষ্ট্রপ্রধান মো. আবদুল হামিদ।

পদত্যাগ করার পর বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ ওঠার কথা সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়।

সর্বোচ্চ আদালত জানায়, ওই সব অভিযোগের ‘গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা’ তিনি না দিতে পারায় সহকর্মীরা তার সঙ্গে এজলাসে বসতে রাজি ছিলেন না। আর সরকারের তরফ থেকে বলা হয়, বিচারপতি সিনহার দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান হবে।

উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে নেওয়া অবৈধ ঘোষণার যে রায় নিয়ে সঙ্কট জটিল মাত্রা পেয়েছিল, সেই রায় পুনর্বিবেচনার জন্য ইতোমধ্যে আপিল বিভাগে আবেদন করেছে সরকার।

বিদায়ী বছরের ঘটনা পরিক্রমায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, বিচারক ও বিচার বিভাগের ভবিষ্যত নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সাবেক আইনমন্ত্রী বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ।  

তার বিশ্বাস, বিচারপতি সিনহাকে পদত্যাগে বাধ্য করেছে সরকার। ফলে এর মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে ‘ধ্বংস করে’ দেওয়া হয়েছে।

নতুন বছরে বিচার বিভাগের জন্য ‘সুখকরও কিছু’ দেখছেন না জানিয়ে এই বিএনপি নেতা বলেন, “বিচার বিভাগের ভবিষ্যৎ হল বিচার বিভাগ কোনো ভূমিকা পালন করতে পারবে না। প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের এই ঘটনায় নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করা এখন বিচার বিভাগের পক্ষে সম্ভব হবে না। আর এভাবে চললে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের অশ্রদ্ধা-অনাস্থা তৈরি হবে।”

প্রধান বিচারপতির পদ এতদিন খালি থাকা ‘অচিন্তনীয়’ মন্তব্য করে মওদুদ বলেন, “এটি একটি সাংবিধানিক পদ। এই পদটি এক ঘণ্টার জন্য শূন্য বা খালি রাখা হবে সম্পূর্ণভাবে সংবিধানের পরিপন্থি। অথচ সেটাই হচ্ছে।”

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সাবেক আইনমন্ত্রী ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শফিক আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পদত্যাগপত্র গ্রহণ করলে প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য হয়েছে বলে একটি গেজেট জারি করতে হয়। এখনও সেই গেজেট হয়নি।

“বিচারপতি এসকে সিনহার মেয়াদ ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ছিল। সরকার হয়ত সেজন্যই অপেক্ষা করছে।”

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের রিভিউ আবেদন প্রসঙ্গে এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, “পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হয়েছে, সপ্তম সংশোধনী বাতিল হয়েছে। আমরা বাহাত্তরের সংবিধানে ফেরত এসেছি। ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে যেটা হয়েছে, আমি আশাবাদী যে সেটা রিভিউয়ে সুধরে যাবে।”

আর বিদায়ী বছরে বিচারাঙ্গনের পরিস্থিতি নিয়ে শফিক আহমেদের বক্তব্য- “আমি তো সবসময়ই প্রত্যাশা করি নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হয়ে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করবে। কারণ হল রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ কী কী কাজ করবে, কীভাবে কাজ করবে তা আমাদের সংবিধানে বলা আছে।”

রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম অবশ্য বিদায়ী বছরকে বিচার বিভাগ এবং নিজের জন্য ‘ঝঞ্জা-বিক্ষুব্ধ বছর’ হিসেবেই দেখছেন ।

বিশেষ করে আধস্তন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি নিয়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ভূমিকা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “ভাল-মন্দ মিলিয়ে এই বছরটা আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে বলে আমি মনে করি।”

তিনি বলেন, “এ বছরে যুদ্ধাপরাধীর কোনো মামলার বিচার আপিল বিভাগে হয়নি। সার্বিকভাবে বলতে গেলে বছরটি ছিল ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের মামলা নিয়ে তোলপাড়। প্রধান বিচারপতির কিছু কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা রকম সমালোচনা।”

বিচারকদের চাকরিবিধি

মাসদার হোসেন মামলার চূড়ান্ত শুনানি করে ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সরকারের নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে আলাদা করতে ঐতিহাসিক রায় দেয়। ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হয়ে বিচার বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়।

আপিল বিভাগের নির্দেশনার পর ২০১৬ সালের ৭ মে আইন মন্ত্রণালয় নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালার একটি খসড়া প্রস্তুত করে সুপ্রিম কোর্টে পাঠায়। সরকারের খসড়াটি ১৯৮৫ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালার অনুরূপ হওয়ায় তা মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরিপন্থি বলে শুনানিতে জানায় আপিল বিভাগ।

এরপর ওই খসড়া সংশোধন করে সুপ্রিম কোর্ট আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। সেইসঙ্গে তা চূড়ান্ত করে প্রতিবেদন আকারে আদালতে উপস্থাপন করতে বলা হয় আইন মন্ত্রণালয়কে। এরপর দফায় দফায় সময় দেওয়া হলেও সরকার মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে ওই বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশ না করায় টানাপড়েন বাড়তে থাকে।

এর মধ্যে গত জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দুই দফা বৈঠক করেন আইনমন্ত্রী। তার ধারাবাহিকতায় তিনি ২৭ জুলাই সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে প্রধান বিচারপতির কাছে চাকরিবিধির খসড়া দিয়ে অসেন। কিন্তু ৩০ জুলাই তা গ্রহণ না করে কয়েকটি শব্দ ও বিধি নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিচারপতি সিনহা।

মতপার্থক্য নিরসনে আইনমন্ত্রী, অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইন মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞদের আলোচনায় ডাকেন প্রধান বিচারপতি। কিন্তু আইনমন্ত্রী সে সময় সুপ্রিম কোর্টে না যাওয়ায় গত ২০ অগাস্ট ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিচারপতি সিনহা।

এরই মধ্যে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সমালোচনার মুখে ছুটি নিয়ে গত ১৩ অক্টোবর দেশ ছাড়ার পর ১০ নভেম্বর ছুটি শেষে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন বিচারপতি সিনহা।

বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পাওয়ার পর তার সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। ৯ নভেম্বর তিনি জানান, চাকরিবিধি নিয়ে মতপার্থক্যের অবসান ঘটেছে।

এর ধারাবাহিকতায় গত ১১ ডিসেম্বর সেই গেজেট প্রকাশ করে সরকার। আগামী ২ জানুয়ারি তা আপিল বিভাগে উপস্থাপনের তারিখ রয়েছে।

বছর জুড়েই দুর্নীতি দমন কমিশনের বিভিন্ন মামলায় অসংখ্যবার সংবাদ মাধ্যমের মুখোমুখি হয়েছেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।

এই একটি বছর কেমন গেল- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “ভালই গেছে বিচার বিভাগ, খারাপ যায়নি। বিচার বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ মামলা বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলা বলেন, সব মামলারই ভাল ভাল রায় এসেছে।”

বিচারপতি সিনহার পদত্যাগের বিষয়ে তিনি বলেন, “এটা তার নিজস্ব ব্যপার। এ নিয়ে আমার বলার কিছু নেই। তবে প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য, এটা অনেকদিন হয়ে গেছে।

“আমার জানামতে বাংলাদেশের ইতিহাসে এতদিনও শূন্য ছিল না কখনও। তাছাড়া এর কোনো ব্যাখ্যাও সংবিধানে দেওয়া হয়নি। কতদিন শূন্য রাখা যাবে যেহেতু সংবিধানে বলা হয়নি, কাজেই এটা বলা যাবে না সংবিধান লঙ্ঘন হয়েছে। তবে এটা আনইউজ্যুয়াল।”

এ আইনজীবী বলেন, “প্রত্যাশা করি নতুন বছরে বিচার বিভাগ আরও সুন্দর সুন্দর রায় দেবে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলা শুনানির জন্য আছে। আমরা নতুন নতুন ব্যাখ্যা পাব। আইনের জুরিসপ্রুডেন্স আরও ডেভলপ করবে, বিচার বিভাগ আরও এগিয়ে যাবে।”

আর আইনজীবী আহসানুল করিমের প্রত্যাশা, নতুন বছরেই যেন বিচারাঙ্গনে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়। 

“সুপ্রিম কোর্টে যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে গেছে, এরকম ঘটনা যেন ভবিষ্যতে আর না ঘটে। এটা শুধু যাদের আদালত অঙ্গনে কাজ করতে হয় তাদের জন্যই নয়, দেশের মানুষের জন্য এমন পরিস্থিতি অনাকাঙ্ক্ষিত। এ ধরনের ঘটনা বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের অনাস্থা তৈরি করে। বিচারের জন্য আশ্রয়ের ক্ষত্রে মানুষের মধ্যে অনীহা-অবিশ্বাস তৈরি করে। মানুষ মনে করবে সবকিছুতেই সরকার নিয়ন্ত্রণ করছে।”

আইজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের টানাপড়েনকে দেখছেন ক্ষমতার দ্বন্দ্ব হিসেবে। তার মতে, বিচার বিভাগের সঙ্গে যে টানাপড়েন- তা প্রকট হয়েছে এ বছর।

“রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গগুলো ঠিক দায়িত্বটুকু যদি প্রতিপালন না করে, তাহলে সেখানে শেষ জায়গা কিন্তু আদালত। আদালতের অবস্থা যদি কোনো কারণে নড়বড়ে হয়ে যায়, তাহলে রাষ্ট্র ব্যবস্থা সঠিকভাবে চলছে তা বলা যাবে না।”

প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ এবং এখন পর্যন্ত প্রধান বিচারপতি নিয়োগ না হওয়া নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন এই আইনজীবী।

“মূলত প্রধান বিচারপতি যদি না থাকেন তাহলে যিনি ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, তিনি তো আর ভার পালন করার মত অবস্থানে থাকলেন না। আমাদের প্রধান বিচারপতি এখন নাই। প্রধান বিচারপতি না থাকলে তার পক্ষে কেউ দায়িত্ব পালন করারও কোনো উপায় নাই। এটা শুধু চেয়ারসর্বস্ব কোনো ব্যপার নয়।

“প্রধান বিচারপতিই যদি না থাকেন তাহলে আপনি রিপ্রেজেন্ট করবেন কাকে? হিসেবে একটা শূন্যতার মধ্য দিয়ে কিন্তু আমরা যাচ্ছি। এই শূন্যতা পূরণ করা বা বিষয়গুলো কিভাবে সামনে সমাধান হবে সেটার উপর ডিপেন্ড করবে বিচার বিভাগের গতিপ্রকৃতি।”