রাইড শেয়ারিং: দিন দিন বাড়ছে অভিযোগ

চালুর পরপর মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও বছরখানেক পেরিয়ে এসে রাজধানীর অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

ওবায়দুর মাসুমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Dec 2017, 09:12 AM
Updated : 26 Dec 2017, 04:11 PM

অতিরিক্ত ভাড়া দাবি, অ্যাপ নির্দেশিত সোজা পথে না গিয়ে ঘুরপথে গন্তব্যে যাওয়া, যাত্রা শুরুর আগেই রাইড চালু করা এবং কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে যেতে অস্বীকৃতিসহ অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগ করেছেন সেবাগ্রহীতারা।

অনভিজ্ঞ চালকের কারণে দুর্ঘটনায় পড়ার অভিযোগও করেছেন অনেকে।

ঢাকায় কার্যক্রম চালানো অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবা ‘শেয়ার আ মোটরসাইকেল’ বা স্যাম, ‌‘পাঠাও’ এবং ‘উবার’ ব্যবহারকারীদের ফেইসবুক গ্রুপ পর্যালোচনার পাশাপাশি তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব অভিযোগ পাওয়া গেছে।

মুহাম্মদ আসিফ ইমরান নামে পাঠাওয়ের একজন সেবাগ্রহীতার অভিযোগ, অনেক মাদকাসক্ত চালক এসব সেবায় ঢুকে পড়েছে।

নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লেখেন, “রাইডার রাইড শেষে অতিরিক্ত টাকা দাবি করে বলে- ‘অ্যাপে ভুল রিডিং শো করে’; কিন্তু আসলে আমি যেখানে গিয়েছি, সবসময় একই দূরত্ব শো করে এবং প্রায় একই টাকা দেখায়। সে নামার পর নানা টালবাহানা শুরু করে এবং (অতিরিক্ত টাকা) দিতে অস্বীকৃতি জানানোর পর বিশ্রী ভাষা প্রয়োগ করে।”

মিরপুরের কাজীপাড়া যেতে মতিঝিলের শাপলা চত্বর এলাকায় সোনালী ব্যাংকের সামনে থেকে পাঠাওয়ের রাইডে উঠেন চন্দন কুমার।

তার অভিযোগ, যানজটের অজুহাত দেখিয়ে চালক তাকে শান্তিনগর-মালিবাগ-মধুবাগ ও হাতিরঝিল হয়ে তেজগাঁও-মহাখালী ঘুরে কাজীপাড়া নিয়ে যায়।

“৩৫-৪০ মিনিটের পথ উনি আমাকে নিয়ে আসলেন ৬৮ মিনিটে। তাও আমার কোনো প্রবলেম ছিল না। কিন্তু বিপত্তিটা বাধল যখন ভাড়া দিতে গেলাম। অ্যাপসে ভাড়া দেখাল ১৩৮ টাকা; আমি ১৪০ টাকা দিলে তিনি বলেন, ‘ভাই এইটা কি দিলেন। ৩০০ টাকা দিলেও আমার পোষাবে না’।”

অনেক বাকবিতণ্ডার পর আশপাশের লোকজন তাকিয়ে আছে দেখে অনেকটা মানসম্মানের ভয় আর বাসায় অতিথি থাকায় বাইকারকে ৩০০ টাকাই দিতে বাধ্য হন জানিয়ে চন্দন বলেন, “পাঠাওয়ে অভিযোগ করেছি। দেখি তারা কি করে।”

উবারের একজন চালকের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ করেন মুহাম্মাদ আবদুর রহমান নামে একজন।

তিনি বলেন, “উবার নির্দেশিত ম্যাপে অনুযায়ী না গিয়ে অন্য রাস্তায় গন্তব্যে পৌঁছায় চালক। যাত্রা শেষ হলে সে আমার কাছে টিপস দাবি করে। আমি এ ব্যাপারে কিভাবে অভিযোগ জানাতে পারি?”

নাজনিন শারমিন সোমা নামে আরেকজনের মন্তব্য, “সিএনজি ড্রাইভাররা যখন অতিরিক্ত ভাড়া নিত, তখন উবার খুব ভালো ছিল। এখন উবার-পাঠাওয়ের ভয়ে সিএনজি চালকরা ভাড়া যখন কমাইলো, এখন উবার অতিরিক্ত ভাড়া নেয়। উবার আমাদের পেয়ে বসেছে। সবসময় অতিরিক্ত সুবিধা খোঁজে খালি।”

কাজী হোসনে মোবারক নামে একজন অভিযোগ করেন, ১০ ডিসেম্বর বনানী থেকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় যেতে উবারে অনুরোধ পাঠান। কিন্তু চালক নতুন বাজার থেকে বনানী আসতে অস্বীকৃতি জানান। চালক দুর্ব্যবহার করেছেন বলেও অভিযোগ তার।

তিনি বলেন, “আমি বললাম আমি ওয়েট করতে পারব, আপনি আসেন। উনি আসবেন না বললেন, আমি বললাম তাহলে ক্যানসেল করে দেন। তারপর উনি বলেন, ‘উবার পেয়ে জমিদার হয়ে গেছেন? ১০০ টাকার ভাড়ার জন্য ৩০০ টাকার গ্যাস পুড়াব?’ এরপরও এখনো ৪০ মিনিট ধরে ঢাকা শহর ঘুরতেছে, কিন্তু ক্যানসেল করে না। এই টাইপ ফালতু ড্রাইভারদের কে কি উবার থেকে নিষিদ্ধ করা যায় না?”

উবারের ভাড়া নিয়ে অসন্তোষ জানালেন পারভেজ আহমেদ।

“একমাত্র বাংলাদেশেই লুটতরাজের ভালো সুযোগ আছে। উবারের রাইড চার্জ কি গ্রহণযোগ্য? মোটেও না। ৬-৭ কিলোমিটার পথ যেতে ভাড়া হয় ৫০০ টাকা, ডিসকাউন্ট বাদ দিলে হয় প্রায় ৪০০ টাকা। এটা রেগুলার যাত্রীদের পক্ষে মোটেও সম্ভব না।”

মঙ্গলবার ‘পাঠাও ইউজারস অব বাংলাদেশ’ ফেইসবুক গ্রুপে মাহমুদুল ইসলাম নামে একজন লেখেন, আগে ভাড়া কম থাকলেও ইদানিং বেশি ভাড়া নেওয়া শুরু করেছে পাঠাও।

“সাধারণত গুলশান-১ থেকে মিরপুর পর্যন্ত সন্ধ্যায় ভাড়া আসে ১৫০-১৬০ টাকা। এরপর পাঠাও আনলো হট জোন সিস্টেম, আজ দেখলাম ১৯৭ টাকা। ডিসকাউন্ট দিয়ে ১৬০ টাকা। হ্যাঁ, পাঠাও একটা অসাধারণ সুবিধা এনে দিয়েছে। তার মানে কি এই যে এখন মানুষের পকেট কাটা শুরু করবে। এইসব সার্ভিসের নামে ফাইজলামি বন্ধ করে মিয়ারা।”

অপ্রশিক্ষিত চালকের কারণে দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন বলে অভিযোগ আরেকজনের। তিনি বলেন, চালক ঠিকমতো মোটরসাইকেল চালাতে পারছিল না। তারপরও অতিরিক্ত গতি তুলতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটায়।

“মিরপুর ১ এর ওভারব্রিজের আগে হঠাৎ রাস্তা ফাঁকা পেয়ে ৬০-৭০ কিলোমিটার গতিতে চালাচ্ছিল। পিছনে ছিল লেগুনা। হঠাৎ ব্রেক করায় সামনের চাকা পিছলে বাইক পড়ে গেল। চালকের হেলমেট থাকায় সে বেঁচে যায়। আমি পিছনে থাকায় ছিটকে পড়লাম লেগুনার সামনে। মাথা থেকে ৩-৪ ফুট দূরে লেগুনা থামাতে পারলো। হাত পা ছিলে গেল।”

পাঠাওয়ে অভিযোগ জানানোর পর ফোন দিয়ে সব শুনে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১০০ টাকা প্রোমো দিল। কিন্তু কথা হল, তারা কিভাবে এসব বাইক নিবন্ধন করে। বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় কে নেবে। ১০০ টাকা প্রোমো দিয়ে কি করব?”

আবদুর রশিদ নামে একজনের অভিযোগ, উবার মটোর সবই ভালো, শুধু একটাই সমস্যা। সবাই ডেস্টিনেশন জানতে চায়।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নের জবাবে উবার এক চিঠিতে জানায়, ইউজারের অনুরোধ পাওয়ার পর সময়, সম্ভাব্য দূরত্ব, সড়কে যানবাহনের অবস্থাসহ কিছু বিষয় বিবেচনা করে প্রাথমিক ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। তবে রাইড শুরুর পর যাত্রাবিরতি, ঘুরপথে যাওয়া, সড়ক বা সেতুর টোলসহ নানা কারণে তা বাড়তে পারে।

ইউজারের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে যেতে অস্বীকৃতি, যাত্রা শুরুর আগেই ট্রিপ চালু করে দেওয়া এবং ইউজারের সঙ্গে খারাপ আচরণ করলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর পরামর্শ উবারের। উবারের অ্যাপেই এ সুযোগ রাখা আছে বলে জানায় উবার।

আর পাঠাওয়ের বিপণন নির্বাহী মুশকিফুল হক সৌমিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, “তাদের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা সবাই দেশের বাইরে আছেন। দেশে ফিরলে এ বিষয়ে কথা বলবেন।

শেয়ার অ্যা মোটরসাইকেল বা স্যাম এর প্রতিষ্ঠাতা ইমতিয়াজ কাসেম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কিছু অভিযোগ আসলেও সেটা খুব বেশি নয়।

তবে পুরো বিষয়টি সরকারের নিয়ন্ত্রণ করা দরকার মন্তব্য করে তিনি বলেন, “অনেক ইউজার আছেন, যারা সামান্য কিছুতেই অভিযোগ করেন। অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবার অনেক সুবিধা আছে। তবে এই সেবার যেহেতু পরিধি বাড়ছে, সে কারণে নানা সমস্যাও তৈরি হচ্ছে। এ কারণে এই সেবাকে একটি নীতিমালার আওতায় আনা জরুরি হয়ে পড়েছে।”

অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবার জন্য রাইড শেয়ারিং নীতিমালা হচ্ছে বলে জানান সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলাম।

“এইটার একটা মনিটরিং সিস্টেম আমরা রাখব। দিনদিন যেহেতু এটার ব্যবহার বাড়ছে, যেহেতু কমপ্লেইনও আসতে থাকবে, এসব অভিযোগ কাউকে না কাউকে তো নজরে আনতে হবে। সেটার সমাধান করতে হবে।”

রাইড শেয়ারিং নীতিমালাটি মন্ত্রিসভায় পাঠানো হয়েছে। সেটি পর্যালোচনা করে অনুমোদন দেওয়া হতে পারে বলে জানান তিনি।