টাকা চেয়েছিল অপহরণকারীরা: উৎপল

দুই মাসের বেশি সময় নিখোঁজ থাকার পর ফিরে আসা সাংবাদিক উৎপল দাস বলেছেন, ঢাকার ধানমণ্ডি এলাকা থেকে তাকে ধরে নিয়ে আটকে রাখা হয়েছিল একটি ঘরে, অপহরণকারীরা তার কাছে টাকাও দাবি করেছিল।

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Dec 2017, 05:29 AM
Updated : 20 Dec 2017, 05:30 AM

তবে কারা তাকে ধরে নিয়েছিল, কোন এলাকায় আটকে রাখা হয়েছিল- সে বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেননি তিনি।

অনলাইন নিউজ পোর্টাল পূর্বপশ্চিমবিডি ডট নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক উৎপল (২৯) গত ১০ অক্টোবর দুপুরে মতিঝিলের অফিস থেকে বের হওয়ার পর থেকে তার খোঁজ মিলছিল না।

মঙ্গলবার রাত পৌঁনে ১২টার দিকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার আধুরিয়া শাহজালাল সিএনজি ফিলিং স্টেশনে একটি মাইক্রোবাস থেকে তাকে নামিয়ে দেওয়া হয়।

খবর পেয়ে সেখান থেকে পুলিশ তাকে নিয়ে যায় ভুলতা ফাঁড়িতে। খবর পেয়ে এসে রাত আড়াইটার দিকে সেখান থেকে উৎপলকে নিয়ে নরসিংদীর রায়পুরার পথে রওনা হন পরিবারের সদস্যরা।

ভুলতা ফাঁড়িতে উৎপল সাংবাদিকদের বলেন, তাকে ধানমণ্ডির স্টার কাবাবের সামনে থেকে অপহরণ করা হয়।

“পেছন থেকে আমাকে ধরে একটি গাড়িতে তোলার পর চোখ বেঁধে ফেলায় কারও চেহারা দেখতে পাইনি। আমাকে নিয়ে টিনশেডের নরমাল একটা ঘরে আটকে রেখেছিল। সেখানে তিন বেলা দরজার নিচ থেকে নরমাল খাবার দেওয়া হত। ঘরে চৌকি বা খাট ছিল না, ফ্লোরে থাকতে হত। ওই ঘরের সঙ্গে একটা বাথরুম ছিল। সেখানে গোসল করতাম।”

উৎপল বলেন, তুলে নিয়ে যাওয়ার পর প্রথম দিকে তাকে চড় থাপ্পড় মারা হয়েছে।

“তারা আমাকে বলত, তোর অনেক টাকা তুই টাকা দে। আমার মোবাইল ফোন তারা নিয়ে নিয়েছিল।”

এই সাংবাদিক বলছেন, মঙ্গলবার রাতে চোখ বাঁধা অবস্থায় তিন-চার ঘণ্টা একটি গাড়িতে করে তাকে ঘোরানো হয়। তারপর নামিয়ে দেওয়া হয় ওই ফিলিং স্টেশনে।

“আমাকে নামিয়ে দেওয়ার সময় চোখের বাঁধন খুলে দিয়ে তারা বলেছে, ‘আমরা যখন গাড়ি টান দেব- তখন তুই চোখ খুলবি’।”

ছেড়ে দেওয়ার সময় উৎপলকে তার মোবাইল ফোনটিও ফেরত দেয় অপহরণকারীরা। সেই ফোন দিয়ে উৎপল যখন স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছিলেন, তখন তাকে দেখতে পান শাহ্জালাল সিএনজি ফিলিং স্টেশনের কর্মচারী ঝন্টু চন্দ্র বণিক।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমি গাড়িতে গ্যাস দেওয়ার সময় দেখি রাত সাড়ে ১১টার দিকে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। আমি তখন তাকে জিজ্ঞেস করলাম- কোথায় যাবেন? তখন উনি ফোনে কথা বলতেছিলেন। ঘণ্টাখানেক পর পুলিশ এসে উনার সঙ্গে কথা বললো।”

রূপগঞ্জ থানার ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক শহীদুল ইসলাম ওই ফিলিং স্টেশনে গিয়েছিলেন পুলিশ সুপারের ফোন পেয়ে।

“এসপি সাহেব ফোন করে বললেন, উৎপল দাস নামের নিখোঁজ একজন সাংবাদিককে পাওয়া গেছে, আমি কোনো তথ্য জানি কি না। আমি বললাম, খোঁজ খবর নিচ্ছি। এরপর সাংবাদিকরাও ফোন করতে শুরু করল। খোঁজ নিয়ে জানলাম উৎপল দাস আছেন শাহ্জালাল ফিলিং স্টেশনে।”

ওই ফিলিং স্টেশনে গিয়ে পরিদর্শক শহীদুল উৎপলকে স্টেশনের ভেতরে নিয়ে যান এবং তার সঙ্গে কথা বলেন। সেখান থেকে ফোনে পুলিশ সুপারের সঙ্গেও তার কথা হয়।

শহীদুল বলেন, “তাকে কে নিয়ে গেছে এমন কিছু সে বলতে পারেনি। কারা নামিয়ে দিয়ে গেছে তাও তিনি বলতে পারেননি। মনে হয় মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে গেছে এবং ফেলে গেছে।”

এদিকে উৎপলের ফিরে আসার খবরে রাত আড়াইটার দিকে ভুলতা পুলিশ ফাঁড়িতে ছুটে আছেন তার মা, বাবা, বোনসহ কয়েকজন আত্মীয়। সেখানে আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়।

উৎপল তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকেন, “আমি ঠিক আছি। আমার কিছু হয়নি।”

উৎপলের বোন বিনিতা রানী সাংবাদিকরা বলেন, রাত সাড়ে ১১টার দিকে তারা ভাইয়ের খবর শুনে তার মোবাইলে ফোন দেন। উৎপল তখন জানান, তিনি আছেন ভুলতায়।

“সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সাংবাদিক ভাইদের চেষ্টায় আমরা ভাইকে ফিরে পেয়েছি। আমরা সবার কাছে কৃতজ্ঞ, সবাইকে ধন্যবাদ জানাই।”

উৎপলের মুক্তির জন্য কেউ টাকা চেয়েছিল কি না জানতে চাইলে বিনিতা বলেন, “একমাস আগে এক লোক ফোন করে বলেছিল, সে নাকি এসআই রিপন তালুকদার। উৎপলকে মুর্মুর্ষ অবস্থায় টাঙ্গাইলে পাওয়া গেছে, তার চিকিৎসার পেছনে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে, এই কথা বলে সে টাকা পাঠাতে বলে।

“তখন আমরা তাকে বলি টাকা পাঠানোর জন্য আমাদের সময় দেন। কিন্তু সে বার বার টাকা পাঠানোর জন্য তাগাদা দেয়। এক ঘণ্টা পর আমরা জানতে পারি ওইটা মিথ্যা একটা খবর।”

উৎপলের বোন বলেন, তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে ২৩ অক্টোবর থানায় জিডি করা হয়। তখন উৎপলের ফোন থেকে কল করে এক লোক এক লাখ টাকা দাবি করে। পরদিন সে আবার টাকা চায়।

“তখন আমার বাবা বলেন যে উনি টাকা দেবেন, কিন্তু কোথায় দেবেন, কীভাবে দেবেন? আগে উৎপলের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিতে বলেন। কিন্তু তারপর আর কোনো ফোন আসেনি।”

উৎপলের বাবা চিত্তরঞ্জন দাস বলেন, “ছেলেকে আমি ফিরে পেয়েছি এটাই আমার বড় আনন্দ। আপনাদের সহযোগিতা বেশি কামনা করি। আমরা এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করছি।”

উৎপল ছাড়াও গত চার মাসে ঢাকায় রাজনীতিক, কূটনীতিক, শিক্ষক ও ব্যবসায়ী মিলে ডজনখানেক মানুষ নিখোঁজ হন।

সর্বশেষ ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বিদেশফেরত মেয়েকে আনতে ধানমণ্ডির বাসা থেকে গাড়ি নিয়ে বিমানবন্দরের উদ্দেশে বের হয়ে নিখোঁজ হন সাবেক কূটনীতিক এম মারুফ জামান।

সাম্প্রতিক সময়ে নিখোঁজদের মধ্যে উৎপলের আগে পরিবারের কাছে ফেরেন ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ রায়, তিনিও আড়াই মাস ‘অজ্ঞাতবাসে’ ছিলেন।