রিমন হত্যা: পুলিশের তদন্তে ফ্ল্যাট নিয়ে বিরোধ, ভাগ্নে গ্রেপ্তার

ঢাকার শুক্রাবাদ এলাকায় মেরিন ইঞ্জিনিয়ার রফিকুল হাসান রিমন হত্যায় জড়িত সন্দেহে তার এক দুঃসম্পর্কের ভাগ্নেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ; জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে রিমনের স্ত্রীকেও।

লিটন হায়দারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Dec 2017, 05:48 PM
Updated : 18 Dec 2017, 05:49 PM

রিমনের বাবা সোমবার নিউ মার্কেট থানায় যে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন, সেখানে অজ্ঞাতনামা আসামিদের আসামি করা হয়েছে।   

তবে স্ত্রী কানিজ ফাতেমার সঙ্গে রিমনের বিবাহ বিচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরুর কথা এবং একটি ফ্ল্যাট নিয়ে ভাগ্নে সাজেদুল করিম রনির সঙ্গে মামলা চলার বিষয়ে তিনি পুলিশকে জানিয়েছেন।

৪২ বছর বয়সী রিমনের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না জানিয়ে শনিবার ঢাকার নিউ মার্কেট থানায় একটি জিডি করেছিল তার পরিবার। রোববার গভীর রাতে  শুক্রাবাদের একটি নির্মাণাধীন ভবন থেকে শেরেবাংলা থানার পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে।

নিউ মার্কেট থানার ওসি আতিকুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রিমনের বাবা মো. খলিল উল্লাহর দায়ের করা হত্যা মামলায় রনির জড়িত থাকার বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। আমরা রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করে যাচ্ছি। আশা করি শিগগিরই ফলাফল পাওয়া যাবে।”

রনি ছাড়াও পুলিশের সন্দেহের তালিকায় আরও কয়েকজন রয়েছে। মামলার এজাহারের ভিত্তিতে শুক্রাবাদ এলাকার নির্মাণাধীন ভবনের দারোয়ান, এক মুরগী বিক্রেতাসহ কয়েকজন জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।

রিমনের বাবা বাবা মো. খলিলউল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, এক সময় জাহাজের ক্যাপ্টেন হিসেবে চাকরি করলেও সংসারে জটিলতা আর ফ্ল্যাট নিয়ে মামলার কারণে গত ছয় মাস ধরে কাজ বাদ দিয়ে রিমন ঢাকাতেই থাকছিলেন।

পারিবারিক জটিলতার কারণে রিমন উত্তরায় তার বোনের বাসায় এবং কানিজ সায়েন্স ল্যাবরেটরি রোডে তার বাবার বাড়িতে থাকছিলেন। তাদের দুই সন্তানের মধ্যে ছেলের বয়স ১০ বছর, আর মেয়ের সাড়ে চার।

মামলার এজাহারে বলা হয়, শনিবার উত্তরার বাসা থেকে ছেলেমেয়েকে নিয়ে বের হন রিমন। পরে বন্ধু রিপনকে দিয়ে দুই সন্তানকে পাঠিয়ে দেন সায়েন্স ল্যাবরেটরি রোডের শ্বশুরবাড়িতে।

পরে রিপন ও রিমন এলিফ্যান্ট রোডের একটি রেস্তোরাঁয় যান এবং সেখান থেকে ধানমণ্ডিতে যাওয়ার কথা বলে রিমন চলে যান। রাত সোয়া  ৯টার দিকে মামাতো বোন মিতুর সঙ্গে ফোনে কথা হয় রিমনের। সে সময় তিনি শুক্রাবাদের মেট্রো শপিং মলে থাকার কথা বলেন। কিন্তু এরপর রাতে বিভিন্ন সময়ে রিমনকে ফোন করা হলেও তা কেউ ধরেনি বলে জানানো হয় এজাহারে। 

পরদিন রাত সাড়ে ১১টার দিকে রিমনের পরিবার জানতে পারে, তার ফোন ব্যবহার করে সোহেল নামে শুক্রাবাদ বাজারের এক মুরগী বিক্রেতা কথা বলেছে। পরে শুক্রাবাদ এলাকায় গিয়ে ওই মুরগী বিক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, একটি নির্মাণাধীন ভবনে তিনি মোবাইল ফোনটি পেয়েছেন।

মুরগী বিক্রেতার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রোববার রাতেই ওই ভবনের বেইজমেন্টে গিয়ে সিঁড়ির গোড়ায় ধুলোর মধ্যে রিমনের মৃতদেহ পাওয়া যায় এবং এরপর পুলিশকে খবর দেওয়া হয় বলে জানানো হয়েছে এজাহারে।

সেখানে বলা হয়েছে, রিমনের নাক-মুখ ছিল রক্তমাখা। চোখ দুটো ছিল ফোলা, মুখ কালচে হয়ে গেছিল। এছাড়া ডান কানের দিকে ছিল থেঁতলানো।

কানিজ ফাতেমা বিডিনিউজ টোয়েন্টফোর ডটকমকে বলেন, “প্রায় আট মাস ধরে আমাদের সম্পর্ক নেই। পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে বিবাহ বিচ্ছেদের কথা চলছিল। আমি যতদূর জানি সে বিচ্ছেদের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তবে আমি এখনও কোনো কাগজ পাইনি।”

এক প্রশ্নের জবাবে কানিজ বলেন, রিমনের সঙ্গে তার মামাতো বোনের প্রেমের সম্পর্কের জেরেই জটিলতার সূত্রপাত হয়। আর এ বিষয়টি পরিবারের সবারই জানা।

তবে তার ওই অভিযোগ অস্বীকার করে রিমনের বাবা বিডিনিউজ টোয়েন্টফোর ডটকমকে বলেন, “রিমনের সঙ্গে বোনের সম্পর্ক ছাড়া অন্য কিছু তার ছিল না।”

রিমনের পরিবার পুলিশকে জানিয়েছে, রনির সঙ্গে রিমনের সম্পর্ক খুব ভাল ছিল। বিভিন্ন অভিযোগে কারাভোগের পর বেকার হয়ে পড়ে রনি। এরই মধ্যে রিমন আগারগাঁও এলাকায় দুটি ফ্ল্যাট কেনেন। একটি ফ্ল্যাটে ২০১৫ সালে রনিকে থাকতে দেন তিনি।

এরপরে রনি কৌশলে ভুয়া  কাগজ বানিয়ে ওই ফ্ল্যাটের মালিকানা দাবি করেন এবং রিমনের বিরুদ্ধে মামলা করে দেন বলে পরিবারের ভাষ্য। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কানিজ ফাতেমাও বলেছেন, ওই ফ্ল্যাট রনি ‘বেদখল’ করে রেখেছিলেন। তবে তিনি নিজে কখনও ফ্ল্যাট দুটি দেখতে যাননি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “কোনো সুবিধা পাওয়ার জন্য রনিই হয়ত রিমনের পেছনে কোনো মেয়েকে লাগিয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে।”

রনির স্ত্রী মমতাজ ময়না বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে দাবি করেন, যে ফ্ল্যাট নিয়ে মামলা, সেটি তারা কিনে নিয়েছেন। তবে কত টাকায় কিনেছেন, কত টাকা পরিশোধ করেছেন- সেসব প্রশ্নে স্পষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেননি তিনি।

এক প্রশ্নের জবাবে ময়না বলেন, তার স্বামীকে একাধিকবার গ্রেপ্তার করা হয়েছিল রাজনৈতিক কারণে।

রিমনের বাবা পুরান ঢাকার সরকারি মুসলিম হাই স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক খলিলউল্লাহ মামলার এজাহারে বলেছেন, ওই ফ্ল্যাট নিয়ে এর আগে তার ছেলের প্রাণনাশের হুমকিও দিয়েছেন রনি।

তবে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে তিনি কানিজের পরিবারকে নিয়েও সন্দেহের কথা বলেছেন।

“ওরা অনেকদিন ধরে আমার ছেলেকে হুমকি দিয়ে আসছিল। কানিজের পরিবারের সাথে রনি কোনো গোপন যোগসাজস করে এ ঘটনা ঘটিয়েছে কি না- তা পুলিশকে তদন্ত করে দেখতে হবে।”

খলিলউল্লাহ বলেন, কানিজের সঙ্গে রিমনের তালাকের প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল। কাবিনের টাকাও পরিশোধ করা হয়েছিল। কেবল আইনগত প্রক্রিয়াটাই বাকি ছিল।

পুলিশ বলছে, ফ্ল্যাট নিয়ে দ্বন্দ্ব ছাড়াও পারিবারিক জটিলতার বিষয়টিকে মাথায় রেখে তারা তদন্ত করছে।

রিমনের ভগ্নিপতি রেজাউল ইসলাম সোমবার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তারা লাশ নিয়ে লক্ষ্মীপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন। সেখানে গ্রামের বাড়িতে রিমনকে দাফন করা হবে।