‘কেন তুমি মেজবানে গেলে’

হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এসে বড় ভাইয়ের মৃতদেহের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন ঝোটন দেব।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Dec 2017, 03:48 PM
Updated : 18 Dec 2017, 03:48 PM

বড়ভাই লিটন দেবের মৃতদেহের উপর থেকে আত্মীয়-স্বজন, হাসপাতালের লোকজন কেউ তাকে টেনে তুলতে পারছিলেন না।

এসময় চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক জিল্লুর রহমান চৌধুরী তাকে টেনে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরেন।

একটু শান্ত হলে ঝোটন দেব বিলাপ করতে থাকেন, “কেন দাদা তুমি মেজবান খেতে গেলে? এভাবে কি কেউ চলে যায়?”

রীমা কমিউনিটি সেন্টারে সোমবার দুপুরে পদদলনে নিহত লিটন দেব (৪৩) নগরীর হাজারী গলির বাসিন্দা। সেখানেই তার ওষুধের দোকান। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। লিটনের এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে।

লিটন দেবের বোন জামাই দীপঙ্কর দেব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সকালে মেজবানে আসার কথা বললে আমি ওকে বলেছি- ওখানে অনেক লোক হবে, আমি যাব না, তুমিও যেও না।

“সে একাই মেজবানে গিয়েছিল। আমরা পরে জানতে পেরেছি।”

প্রয়াত নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কুলখানি উপলক্ষে আয়োজিত এই মেজবানে পদদলনে লিটনসহ নিহত হন ১০ জন।  

নিহতদের মধ্যে নয়জনের পরিচয় জানা গেছে। অন্য একজনের নাম-পরিচয় জানা যায়নি।

নিহতরা হলেন- কৃষ্ণপদ দাশ (৪৫), সুধীর দাশ (৫০), ঝন্টু দাশ পিন্টু (৪৫), প্রদীপ তালুকদার (৪৬), লিটন দেব (৪৩), দীপঙ্কর দাশ রাহুল (২৬), সত্যবত ভট্টাচার্য্য (৪২), অলক ভৌমিক (৩২) ও ধনা শীল (৬০)।  

কৃষ্ণপদ দাশের ছেলে শুভ দাশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা চার-পাঁচজন আসার কথা ছিল মেজবানে। কিন্তু সকালে কেউ আসতে রাজি না হলে বাবা একাই মেজবানে যান।”

আগ্রাবাদের গোসাইলডাঙ্গার বাসিন্দা ঠিকাদার প্রদীপ তালুকদার (৪৬)। তার দুই মেয়ের একজন এসএসসি ও অন্যজন জেএসসি পরীক্ষার্থী।

প্রদীপ তালুকদারের বোন জামাই লিটন ভৌমিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গতরাতে ব্যবসার কাজ শেষে তিনি বান্দরবান থেকে ফেরেন। সকালে মেজবানের খবর শুনে সেখানে গিয়েছিলেন।

সোমবার বিকালে নিহতদের স্বজনরা লাশ নিতে হাসপাতালে ভিড় করলে সেখানে বেদনাবিধুর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।

নিহতদের স্বজনদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাও কান্নায় ভেঙে পড়েন। ছুটে আসেন নগর বিএনপি সভাপতি শাহাদাত হোসেনও।

হতাহতদের দেখতে গিয়ে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েন চৌধুরী মহিবুল হাসান নওফেল। ছবি: সুমন বাবু

মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছিলেন।

নিহতদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। তার সঙ্গে থাকা মিরসরাই উপজেলা চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন এবং রাউজান উপজেলা চেয়ারম্যান এহছানুল হায়দার চৌধুরী বাবুলকে কাঁদতে দেখা যায়।

পরে নওফেল অসুস্থ হয়ে পড়লে রাউজানের সাংসদ ফজলে করিম চৌধুরীসহ অন্যরা তাকে ধরাধরি করে গাড়িতে তুলে মেয়র গলির বাসায় নিয়ে যান।

নিহতদের মধ্যে প্রকৌশলী, শিক্ষার্থী

নিহত সত্যব্রত ভট্টাচার্য্য (৪২) রাঙামাটি জেলার দক্ষিণ কালিন্দিপুর এলাকার অমলেন্দু ভট্টাচার্য্যের ছেলে।

সত্যব্রত এলজিইডির লক্ষ্মীপুর কার্যালয়ে উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদে কর্মরত ছিলেন। নগরীর আসকার দিঘীর পাড়ে তাদের বাসা।

সত্যব্রতের ভাই পুলক ভট্টাচার্য্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সকালে উনি বাসা থেকে বের হন। পরে বিকেলে ফোন পেয়ে আমরা হাসপাতালে আসি।”

সত্যব্রতের অন্য একজন স্বজন জানান, মেয়ের স্কুলে ভর্তির কাজে ভর্তি ফরমসহ সকালে তিনি বাসা থেকে বের হন। তার পকেটে সেই ভর্তি ফরমও ছিল। সম্ভবত বাসায় ফেরার সময় তিনি কমিউনিটি সেন্টারে কী হচ্ছে তা দেখতে গিয়েছিলেন।

“ফোনে দীর্ঘক্ষণ না পাওয়ার পর সন্ধ্যার দিকে আমরা তার খোঁজ পাই।”

রীমা কমিউনিটি সেন্টারে ভিড়ের মধ্যে পদদলিত হয়ে হতাহতের পরের চিত্র। ছবি: সুমন বাবু

দীপঙ্কর দাশ রাহুল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি কক্সবাজার জেলার চকরিয়ার সনাতন দাশের ছেলে। 

নিহতদের মধ্যে নগরীর পাহাড়তলি এলাকার খেজুরতলার বাসিন্দা কৃষ্ণপদ দাশ মাছ ধরার জাল বিক্রি করতেন।

পাথরঘাটার লালমোহন দাশের ছেলে সুধীর দাশ জেলে। জামালখানের শরিফ কলোনির বাসিন্দা বিনোদ বিহারী দাশের ছেলে ঝন্টু দাশ পিন্টু নগরীর এপোলা শপিং সেন্টারে দোকান কর্মচারী।

নগরীর গোসাইলডাঙ্গা এলাকার বাসিন্দা প্রদীপ তালুকদার ঠিকাদারি ব্যবসা করতেন।

আনোয়ারা উপজেলার মহছেন আউলিয়া এলাকার প্রকৃতরঞ্জন দেবের ছেলে লিটন দেব নগরীর হাজারী গলিতে ওষুধ ব্যবসায়ী ছিলেন।  

অলক ভৌমিক সীতাকুণ্ড উপজেলার ছোট কুমিরার ননী গোপাল ভৌমিকের ছেলে।

ধনা শীলের বিস্তারিত পরিচয় জানা যায়নি।

১১ জন আহতের মধ্যে নয়জনের পরিচয় জানা গেছে।

তারা হলেন- বাসু সিংহ (৪৮), রবিন দাশ (৩৫), মনোজ বড়ুয়া (৫৫), উজ্জ্বল চৌধুরী (৪৪), আবু তাহের (৪০), সুমন দাশ (৩৫), মো. হারুন (৫০), দুলাল দাশ (৫০), চবি বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী অর্পণ বিশ্বাস (২৩)। এদের মধ্যে আইসিইউতে আছেন অর্পণসহ তিনজন।

আহতদের মধ্যে বাসু সিংহ নগরীর জামালখাই বাই লেইন, রবিন দাশ কালুরঘাট ফরেস্ট ডিপো, মনোজ বড়ুয়া ব্যাটারি গলি, উজ্জ্বল চৌধুরী পাথরঘাটা, আবু তাহের কক্সবাজার জেলার মহেশখালির, সুমন দাশ আনোয়ারা উপজেলার, মো. হারুন হাটহাজারী উপজেলার, দুলাল দাশ মোমিন রোডের এবং অর্পন বিশ্বাস নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা।