বিজয়ের খবরে গুলি ছুড়ে উল্লাস করেছিলাম: নুরুন্নবী চৌধুরী

নিরীহ নিরাপরাধ লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু, নারীর সম্ভ্রমহানি, দেশজুড়ে তাণ্ডবলীলা-সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে রুখে দাঁড়িয়ে বাঙালির চূড়ান্ত বিজয় ছিনিয়ে আনার মুহূর্তটি কেমন ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে- সেই বিবরণ উঠে এসেছে একজন মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে।

উত্তম সেন গুপ্তবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Dec 2017, 06:45 PM
Updated : 16 Dec 2017, 06:59 PM

বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের (বিএলএফ) একটি অঞ্চলের কমান্ডার নুরুন্নবী চৌধুরী অস্ত্র হাতে লড়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রামে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরপরই চট্টগ্রামের শুভপুর ব্রিজে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে প্রথম প্রতিরোধকারীদের একজন ছিলেন তিনি।

বিজয়ের ৪৬তম বার্ষিকীতে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অনুভূতি তুলে ধরেছেন তিনি।

“দেশ স্বাধীনের অনুভূতিটা ছিল আমাদের কাছে সুখের। আমাদের কোম্পানির দায়িত্বে থাকা ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর পুরকায়স্ত আমাদের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসম্পর্ণের বিষয়টি জানায়। সাথে সাথে আমরা গুলি ছুড়ে উল্লাস করি।”

ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া নুরুন্নবী চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে তরুণ-যুবকদের সংগঠিত করে মিরসরাইয়ে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের ব্যবস্থা করেছিলেন। পরে শেখ ফজলুল হক মনির নির্দেশে চট্টগ্রাম ছেড়ে চলে যান ভারতের উদয়পুরে, এক মাস ট্রেনিং নিয়ে ফেরেন রণাঙ্গনে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি তুলে ধরেছেন সেই সময়ের ঘটনাপ্রবাহের বিশদ বিবরণ।

চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম হাই স্কুলে পড়ার সময় বিহারি ছাত্রদের সঙ্গে বাঙালিদের বৈষম্য মেনে নিতে পারেননি নুরুন্নবী।

সেখানে বিহারি ছাত্রদের জন্য ছিল আলাদা ক্লাস রুম। তাদের জন্য ছিল উর্দু ভাষায় পাঠদান। ১৯৬১ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিহারি ছাত্রদের সাথে বিরোধে জড়িয়ে স্কুল ছাড়তে হয় তার।

এরপর নুরুন্নবী জেএম সেন হাই স্কুলে ভর্তি হয়েই নির্বাচিত হন স্কুল ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক। ৬২’র শিক্ষা আন্দোলনে যখন রাজপথ উত্তাল সে সময় ছাত্র সগ্রাম পরিষদের মাধ্যমিক শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। ওই কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শহীদ আব্দুর রব।

১৯৬২ সালেই চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক নির্বাচিত হন নুরুন্নবী। তার ওই কমিটির সভাপতি ছিলেন চট্টগ্রামের প্রয়াত সংসদ সদস্য এমএ মান্নান।

১৯৬৬-৬৭ সালে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নুরুন্নবী। মুক্তিযুদ্ধের সময় আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর জেলা প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন তিনি।

রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা নিয়ে নুরুন্নবী জানান, তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান মাদারবাড়ি এলাকায় গড়ে তুলেছিলেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ কার্যালয়। তা উদ্বোধন করতে এসেছিলেন আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ও শেখ মুজিবুর রহমান। সেখানে বক্তব্য দিয়েছিলেন শেখ মুজিব। এরপরে এমএ আজিজ, জহুর আহমেদ গ্রেপ্তার হওয়ার পর লালদিঘী মাঠে প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।

“শেখ মুজিবের সে বক্তব্য আমাকে রাজনীতিতে যাওয়ার অনুপ্রেরণা যোগায়।”

নুরুন্নবী বলেন, ছেষট্টির ছয় দফা যখন পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করার এক দফা দাবিতে পরিণত হয় তখন ছাত্রলীগকে সংগঠিত করতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছিল।

“মেধাবী ও অন্য ধর্মাবলম্বীরা সে সময় ছাত্রলীগের রাজনীতিতে আসতে চাইতেন না। তারা যেতেন ছাত্র ইউনিয়নে। তখন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গ্রামে গ্রামে ঘুরতে হয়েছিল কর্মী সংগ্রহ করতে।”

মুক্তিযুদ্ধে তার অংশগ্রহণ নিয়ে নুরুন্নবী চৌধুরী বলেন, ২৫ মার্চের কালোরাতে পাকিস্তানি বাহিনী যখন গণহত্যা শুরু করে তখন চট্টগ্রামের হালিশহর থেকে ক্যাপ্টেন রফিকের নেতৃত্বে (১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার) প্রতিরোধ করা হয়।

পাকিস্তানি বাহিনী কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামের দিকে আসছে জেনে মিরসরাইয়ের শুভপুর ব্রিজে ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেনের নেতৃত্বে তাদের প্রতিরোধ গিয়েছিলেন চট্টগ্রামের ২০ থেকে ২৫ জন যুবক। তাদের অধিকাংশই ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে ছিলেন নুরুন্নবী।      

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে প্রথমে অস্ত্র সংগ্রহ শুরু করেছিলেন তারা। অস্ত্রের মজুদ বাড়াতে লুট করেছিলেন অস্ত্রের দোকানও। সেগুলো বিলি করা হয়েছিল যুদ্ধে যাওয়া তরুণ-যুবকদের।

নুরুন্নবী বলেন, অনেক তরুণ স্বেচ্ছায় বাড়ি ছেড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে। তারা সবাই ভারতে যেতে পারছিলেন না প্রশিক্ষণ নিতে। মিরসরাইয়ের অবসরপ্রাপ্ত এক হাবিলদারকে প্রশিক্ষক নিয়োগ দিয়ে চরসরত এলাকায় একটি ট্রেনিং ক্যাম্প করা হয়েছিল।

ভেড়ার খামারে তৈরি করা এ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেওয়া তরুণদের বিভিন্নভাবে উদ্বুদ্ধ করার কাজ করতেন নুরুন্নবী। পরে সেখান থেকে ট্রেনিং নেওয়া যুবকরা বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ার পর তাদের থাকা খাওয়ারও ব্যবস্থা করতেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে শেখ ফজলুল হক মনি এসএম ইউসুফকে পাঠিয়ে তাকে ভারতে যাওয়ার নির্দেশনা দেন বলে জানান নুরুন্নবী।

এরপর যাত্রা করে মিরসরাইয়ের শান্তির হাটে তারা ধরা পড়েন রাজাকার বাহিনীর হাতে। কোমরে থাকা রিভলবার থেকে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুড়ে সেখান থেকে পালিয়ে যান নুরুন্নবী ও ইউসুফসহ আরও ২৫ থেকে ৩০ জন যুবক।

ভারতের হরিণা ক্যাম্পে গিয়ে এমএ হান্নানের সঙ্গে দেখা করেন নুরুন্নবী। সেখান থেকে উদয়পুর চলে যান শেখ মনির বাসায়। ত্রিপুরায় কয়েকদিন অবস্থানের পর একটি রুশ বিমানে চলে যান শাহরারপুর। সেখান থেকে তন্দুয়া গিয়ে এক মাস সাতদিনের প্রশিক্ষণ নেন।

প্রশিক্ষণ শেষে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় আসামের কুম্বি গ্রামে, সেখান থেকে মিজোরামের দেমাগ্রীতে।

দেমাগ্রীতে মেজর জেনারেল উবানের নেতৃত্বে তারা যুদ্ধের পরিকল্পনা সাজান জানিয়ে নুরুন্নবী বলেন, “দেশে তখন তুমুল যুদ্ধ চলছে। আমাকে করা হয় নর্থ কলামের এবং মহিউদ্দিন চৌধুরীকে করা হয় সাউথ কলাম কমান্ডার।

“আমার নেতৃত্বে একটি দল খাগড়াছড়ি, রামগড়, গুঁইমারা, মায়নিমুখ মারিশ্যা এলাকায়, আর মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে একটি দল রাঙামাটি পার্বত্য অঞ্চলে চলে যায়। সেখানে যুদ্ধ করতে গিয়ে আমাদের অনেক সময় মিজোদের সাথে লড়াই করতে হয়েছিল।”

স্বাধীনতার শেষভাগে এসে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে পাকিস্তানি বাহিনী বিতাড়িত হয় জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের মধ্যে কিছু দলছুট সদস্য পালিয়ে যেতে পারেনি। দিঘীনালা নয়াবাজার এলাকায় তারা চা খেতে আসত।

“একদিন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের কাছে বিষয়টি জানতে পেরে আমরা তাদের ধরে ফেলি এবং অস্ত্র লুট করে নিয়ে যাই।”

এরপর ১৬ ডিসেম্বর আসে বিজয়ে চূড়ান্ত মুহূর্ত।

দেশের মুক্তি সংগ্রামের সেনানি নুরুন্নবী বলেন, “একটি যুদ্ধ দিয়েই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। বুলেটের মাধ্যমে এটা আসেনি। দীর্ঘদিনের জনগণের মনের ক্ষোভগুলোকে উজ্জীবিত করতে পেরেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তাতেই আসে স্বাধীনতা।”

মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোনোর আগে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া নুরুন্নবী বর্তমান ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড নিয়ে ক্ষুব্ধ।

তার মতে, ছাত্রলীগ এখন আদর্শের রাজনীতি থেকে দূরে সরে গেছে।

“তারা এখন কোনো সাংগঠনিক সভা করে না। তারা রাজনৈতিক সভা নিয়ে ব্যস্ত। কেন্দ্র থেকে ইউনিট কোথাও কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রম নেয়,”

নুরুন্নবী এখন রাজনীতি থেকে দূরে। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খুন হওয়ার পর আর কোনো সভা সমাবেশে অংশ নেননি তিনি।

“যে জাতির স্বাধীনতার জন্য কাজ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু তাকে খুন হতে হয়েছে নিজের স্বাধীন দেশে। ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু ও মনির মৃত্যুর পর নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়েছে। তাদের জন্য কিছুই করতে পারিনি। সেজন্য রাজনৈতিক মঞ্চে গিয়ে আর বাহাদুরি করতে ইচ্ছে হয়নি। নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছি রাজনীতি থেকে,” বলেন এই মুক্তিযোদ্ধা।