‘মেয়ের মুখ দেখার চেয়ে শেখ হাসিনার স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন মহিউদ্দিন’

ক্যান্সার আক্রান্ত মেয়েকে দেখতে কারাগার থেকে মুক্তির জন্য সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সদ্য প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন চৌধুরী।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Dec 2017, 02:03 PM
Updated : 16 Dec 2017, 02:17 PM

দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার ক্ষতি হবে, তাই স্বাক্ষর না করে সেই কাগজ তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন বলে তার ছেলে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল জানিয়েছেন।

শনিবার বিকালে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে নগর আওয়ামী লীগ আয়োজিত বিজয় দিবসের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নওফেল।

তিনি বলেন, “একজন শেখ হাসিনাই আমাদের রাজনৈতিক আদর্শ। তার আদর্শে নিবেদিত শত হাজার নেতাকর্মী সারা দেশে আছেন, তেমনি একজন ছিলেন আমার বাবা।

“এক এগারোর সময় আমাকে একটি স্টেটমেন্ট (বিবৃতি) দেওয়া হয়। বলা হয়, এতে আমার বাবার সাইন (সাক্ষর) নিয়ে আসলে তাকে বিদেশে যেতে দেবে। আমার বোন টুম্পা তখন বিদেশে মৃত্যুশয্যায়।

মহিউদ্দিন চৌধুরী

“সেটি নিয়ে আমি জেলখানায় বাবার সাথে দেখা করতে যাই। বাবা বললেন, আশরাফের (সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম) কাছে যাও। আমি উনার বাসায় গেলাম।

“তিনি (সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম) বললেন, মহিউদ্দিন ভাই কী সিদ্ধান্ত নেবেন সেটা তার এখতিয়ার। তিনি ভালো জানেন রাজনীতিতে কখন কী সিদ্ধান্ত নিতে হয়।”

পরের ঘটনা তুলে ধরে নওফেল বলেন, “আমি আবার জেলখানায় গেলাম বাবার কাছে। তিনি আমাকে বললেন, এটাতে (বিবৃতি) সই দিলে আমার মেয়ে কী বাঁচবে? আমি বলেছিলাম, সেটা তো আল্লাহর হাতে।

“তখন তিনি বলেন, আমি আমার বোনের (শেখ হাসিনা) এত বড় ক্ষতি করতে পারব না।”

পরের বছর অক্টোবরে জামিনে মুক্তি পেয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরী যখন ব্যাংকক পৌঁছান, তার আগেই তার মেয়ে ফৌজিয়া সুলতানা টুম্পার মৃত্যু হয়।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মহিউদ্দিন চৌধুরী

দলীয় প্রধানের জন্য বাবার এই আত্মত্যাগের কথা তুলে ধরে নওফেল বলেন, “বোনের জন্য, নেত্রীর জন্য নিজের পরিবার ও আপনজনকে বাবা বিসর্জন দিয়েছিলেন। দল ও নেত্রীর জন্য থ্রেট আসে এমন কিছু তিনি কখনও করেননি।”

ষাটের দশকে ছাত্রলীগের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামে আয়ূববিরোধী আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে বিএলএফের (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স) মিডল ও সাউথ কলামের কমান্ডার হন তিনি।

পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর গ্রেপ্তার হন মহিউদ্দিন চৌধুরী। মুক্তি পেয়ে প্রতিশোধ নিতে গঠন করেন ‘মুজিব বাহিনী’, পরে পালিয়ে যান ভারতে। ১৯৭৮ সালে দেশে ফিরে শ্রমিক রাজনীতিতে সক্রিয় হন এই আওয়ামী লীগ নেতা।

প্রায় তিন দশক চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

মহিউদ্দিন চৌধুরীকে ভাই বলে সম্বোধন করতেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

শুক্রবার ভোরে মহিউদ্দিনের মৃত্যুর খবর জানার পর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘কান্নায় ভেঙে পড়েন’ বলে জানিয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

মহিউদ্দিন চৌধুরীর সাথে দলীয় সভানেত্রীর পারিবারিক সখ্যের কথা রাজনৈতিক মহলে সুবিদিত। মহিউদ্দিনের সন্তানরা শেখ হাসিনাকে ‘ফুপু’ বলেই সম্বোধন করেন।

এর আগে ২০১৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মহিউদ্দিন চৌধুরীকে নিয়ে লেখা বই ‘স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’র মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওই ‘রাজনীতি ছাড়ার শর্তের’ বিষয়টি আলোচনা আসে।

সেদিন মহিউদ্দিন চৌধুরীর স্ত্রী হাসিনা মহিউদ্দিন বলেছিলেন, “আর রাজনীতি করবেন না এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে বন্ডে সই করলে মহিউদ্দিনকে প্যারলে মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন সে সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান।”

চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে ব্যবসায়ীদের এক সমাবেশ শেষে কুলি-মজুরদের আলিঙ্গনে মহিউদ্দিন চৌধুরী, এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘চট্টলা বীর’

ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকলেও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি মহিউদ্দিন।

গত ১৭ অক্টোবর টুম্পার মৃত্যুবার্ষিকীতে নগরীর চশমা হিলের বাসায় কথোপকথনের এক পর্যায়ে ওই মেয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে মহিউদ্দিন চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “বুড়ো হয়ে গেছি। আমি তো বুড়ো বাপ।

“তার নামে দুটা স্কলারশিপ চালু করেছি। গরিব ছেলে-মেয়েরা যেন লেখাপড়া করতে পারে। আর কিছু করিনি।”

আরও পড়ুন