যুদ্ধটা ‘শেষ হয়নি’, লড়বে প্রজন্ম

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে শত ত্যাগ-তিতিক্ষায় এসেছিল বিজয়ের যে লাল-সবুজ পতাকা, ৪৬ বছর পর বিজয় উদযাপনে সেই পতাকার মর্যাদা রক্ষার যুদ্ধে সামিল হওয়ার দৃপ্ত প্রত্যয় দেখা গেছে এ প্রজন্মের কিশোর-যুবকদের কণ্ঠে।

জয়ন্ত সাহা নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Dec 2017, 07:58 AM
Updated : 16 Dec 2017, 08:02 AM

তারা বলছে, একাত্তরের সশ্রদ্ধ যুদ্ধ থেমে গেলেও বাঙালির স্বাধিকার আদায়, অর্থনৈতিক মুক্তির যুদ্ধ শেষ হয়নি; অন্যায়-অত্যাচার আর সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা চলছে।

আর তাই বিজয় উদযাপনে আসা গৌরব ও অহঙ্কারে দৃপ্ত এই তরুণদের কথায় পাওয়া যায় একযোগে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার শপথ।

বিজয় মুহূর্ত উদযাপনের নানা আনুষ্ঠানিকতা চলছে রাজধানী জুড়ে। দিনের শুরুতে বাঙালির অধিকার সংগ্রামের অন্যতম সূতিকাগার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিজয় শোভাযাত্রা ও পতাকা মিছিলের আয়োজন করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও শিশু একাডেমি।

বাঙালির বিজয় দিবস উদযাপনের শুরুতে সে আয়োজনে যোগ দিয়ে রাজধানীর শত কিশোর-যুবক আর তরুণীর দল একসঙ্গে শপথ নিল, অসমাপ্ত যুদ্ধটা তারা লড়ে যাবে। মুক্তি সেনাদের মতো তারাও দেশ মাতৃকার জন্য আমৃত্যু লড়াই করে বাঙালির কাঙ্ক্ষিত বিজয় ছিনিয়ে আনতে প্রস্তুত।

সকাল ৯টা থেকে বিজয় নিশান লাল-সবুজের পতাকা হাতে আসতে থাকে নগরীর বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিশুরা। তাদের পরনেও লাল-সবুজ; কেউ মাথায় জড়িয়েছে, কেউ বা মুখে এঁকেছে বিজয়ের পতাকা। কারও হাতে আবার স্টিকার, সেখানে বিজয়বার্তা লেখা। 

কেউ আসে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর বিশাল প্রতিকৃতি নিয়ে। শিশুরা জানে, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি এ নেতাই একাত্তরের সাতই মার্চ দৃপ্ত কণ্ঠে ডাক দিয়েছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের। তারা জানে, কতটা রক্ত ঝরাতে হয়েছে, কতটা ত্যাগ-তিতিক্ষা আর যন্ত্রণা সইতে হয়েছে বাঙালিকে। ওরা জানে, যুদ্ধটা কি ছিল।

মেহেদি হাসানের বাসা মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের খুব কাছে। পাক সেনাদের সঙ্গে আঁতাত করে এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনী কিভাবে এ দেশের মানুষকে হত্যা করেছে, এ দেশের শিশুদের মেরে ফেলেছে- সে কথা মায়ের কাছ থেকে শুনে ওর মনে পাকিস্তানিদের প্রতি জেগেছে ঘৃণা।

দেশের জন্য লড়াই করতে প্রস্তুত একদল শিশু তখন বলে উঠল, একাত্তরের বীর সেনাদের মতো তারাও অস্ত্র হাতে লড়তে প্রস্তুত। তাদের কেউ সীমান্ত প্রহরী হতে চায়, কেউ আকাশপথে-স্থলপথে আর জলপথে শত্রু সেনাদের হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে সশস্ত্র বাহিনীতে যোগ দেওয়ার স্বপ্নের কথা বলে। কেউ আবার পেশাগত অবস্থানে থেকে নিজের সেরাটা ঢেলে দিয়ে দেশের জন্য লড়াই করবে বলে প্রত্যয় জানায়।

পতাকা মিছিলে যোগ দেওয়া শিশু ফাতেমা আক্তার বলে, “যুদ্ধটা কেবল বড়দের না, আমাদেরও। আমরাও কিন্তু লড়ছি প্রতিদিন।  সমাজে কন্যা শিশুদের বাজেভাবে দেখা হয় এখনো। আমরা সব শিশুরা মিলে যদি প্রতিবাদ করি, তবে নিশ্চয় আমাদের অধিকার আদায় করতে পারব। এটাও বড় যুদ্ধ।”

পুরান ঢাকার হাজী আবদুল গণি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী শামসুন্নাহার মৌমিতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলে, “তখন যদি জন্ম নিতাম, হয়তো যুদ্ধে যেতাম। এখন তো যুদ্ধ নেই। তাই বলে যুদ্ধটা থেমে নেই। আমাদের মতো অনেক শিশু স্কুলে যায় না। আমার বয়সী অনেক মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। আমি বড় হয়ে এ অসহায় শিশুদের জন্য লড়ব। ”

কবি নজরুল সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ঝর্ণা আক্তার বৃষ্টি বলে, “সরকার, রাষ্ট্র কী করবে, সেটা আর দেখব না। এবার তরুণরা মিলে ছোট ছোট অবদান রাখলেই দেশের অনেক চিত্র বদলে যাবে।”

তরুণ নাট্যকর্মী এ কে এম মঞ্জুর মামুন বলেন, “এ সময়ের যুদ্ধটা শ্বাস-প্রশ্বাসের, আমরা লড়ছি দূষিত বাতাসের বিরুদ্ধে।  বাতাসটাকে তাজা রাখতে আমাদের লড়াই করতে হচ্ছে। আমাদের প্রজন্ম তো বটেই, আগামী প্রজন্ম যেন একটা মুক্ত হাওয়ায় বেড়ে উঠতে পারে, আমরা সে লড়াই করছি।”

শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী মাহবুবা সিদ্দিকা সুমী বলেন, “অনেক যুদ্ধাপরাধীকে এখনো চিহ্নিত করতে পারিনি আমরা। হয়তো আমাদের ঘরেই ঘাপটি মেরে আছেন তারা। আমরা তাদের চিহ্নিত করব। তরুণদের কাঠগড়াতেই সমুচিত বিচার হবে ওদের।”

সংস্কৃতিকর্মী অনামিক রায় মুক্তবাক ও মুক্ত চিন্তা চর্চার স্বাধীনতা আদায়ের পথে তরুণদের লড়াই চলবে বলে দৃপ্ত প্রত্যয় জানান।

সমাবেশে এসেছিলেন সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবির আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সৈয়দ হাসান ইমাম।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া চলছে। এটা কিন্তু বিরাট এক ব্যাপার! নব্বইয়ের দশকে আমরা যে দাবিটা তুলেছিলাম, সে দাবি আজ সত্যি পরিণত হল। 

“আজ শপথ গ্রহণের দিন, আমরা যে যুদ্ধটা লড়েছিলাম ৪৬ বছর আগে, সেই যুদ্ধের ব্যাটনটা এখন তরুণদের বইয়ে নিয়ে যেতে হবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন, শহীদের আদর্শ অনুযায়ী অসাম্প্রদায়িক, অর্থনৈতিক বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন অপূর্ণ রয়ে গেছে, তা তরুণরাই পূরণ করবে।”

মানবিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে সাংস্কৃতিক অভিযাত্রা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার।

সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে লাখো শহীদের আত্মদান, বীরাঙ্গনাদের লড়াইয়ের কথা গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াই অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ।

সংস্কৃতিকর্মী নিগার সুলতানা বলেন, “একাত্তরের যুদ্ধে নারীর যে আত্মত্যাগ, সেই আত্মত্যাগের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় লড়াই করতে হচ্ছে এখনো। আমাদের লড়াইটা থেমে যায়নি। সব ক্ষেত্রে নারী এগিয়ে চলছে। এ অভিযাত্রায় বাধা উপেক্ষা করে এগিয়ে চলার যুদ্ধ চলছে, চলবে। এ যুদ্ধে লড়ছে তরুণীরা, শেষে জয়ী হবে তারা।”

বিজয় শোভাযাত্রাটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে বের হয়ে দোয়েল চত্বর, বাংলা একাডেমি, টিএসসি, জাতীয় গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের সামনে দিয়ে ঘুরে যায়।

ঢাক-ঢোল আর কাসরের তালে নেচে গেয়ে বিজয় মুহূর্ত উদযাপন করেন সংস্কৃতিকর্মীরা। ঐতিহাসিক সাতই মার্চের স্বীকৃতি উদযাপনের ধারাবাহিকতায় উদযাপনের অংশ হিসেবে শোভাযাত্রার ঠাঁই পায় বঙ্গবন্ধুর বিশাল সব প্রতিকৃতি। একদল মুখাভিনেতা পথ চলতে চলতে মঞ্চস্থ করছে ক্ষুদ্র নাটিকা। তরুণীদের একটি দল সেজে এসেছিল বাঙালির আটপৌরে সাজে।

বিজয় দিবস উপলক্ষে নগরী জুড়েই চলছে নানা কার্যক্রম। সকালে রাজধানীর হাতিরঝিলে বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় সাইকেল র‍্যালি।

বিজয় দিবস উপলক্ষে শনিবার বিকালে শাহবাগের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজন করেছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন ঘোষণা করবেন।

এছাড়া শিখা চিরন্তনে শহীদদের আত্মদানের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন ও তরুণ প্রজন্মের হাতে পতাকা হস্তান্তর অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম।

বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে রয়েছে ছায়ানটের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে সহযোগী হিসেবে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নিজেদের প্রাঙ্গনে ও মিরপুর জল্লাদখানায় আয়োজন করেছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। 

বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলা একাডেমি ও শিল্পকলা একাডেমিতে রয়েছে আলোচনা সভা। এছাড়া শিশু একাডেমিতে শনিবার বিকালে অনুষ্ঠিত হবে শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা।