একাত্তরের সম্মুখ সমরে: সম্মিলিত আক্রমণে ভাঙল পাকিস্তানি প্রতিরক্ষাব্যূহ

একাত্তরে পাকিস্তানিদের সঙ্গে যুদ্ধ তখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, কয়েকটি সীমান্ত এলাকায় বড় রকমের অগ্রাভিযানে অংশ নিচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনী। ডিসেম্বরের শুরুতে আখাউড়া সীমান্তে পাকিস্তানি ঘাঁটিতে বড় ধরনের আক্রমণের পর তাদের প্রতিরক্ষা ধ্বংস করে সহজে ঢাকামুখী হয়ে যান মুক্তিযোদ্ধারা।

মাসুম বিল্লাহ কাজী নাফিয়া রহমান ও সাজিয়া আফরিনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Dec 2017, 05:23 AM
Updated : 16 Dec 2017, 09:56 AM

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ৪৬তম বার্ষিকীতে সাক্ষাৎকারে আখাউড়া যুদ্ধের আদ্যোপান্ত শুনিয়েছেন সেই যুদ্ধের একটি কোম্পানির কমান্ডার গোলাম হেলাল মোর্শেদ খান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধে সামরিক দিক থেকে আখাউড়ার যুদ্ধ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সেখানে প্রতিরক্ষাব্যুহ ভেঙে যাওয়ার পর পাকিস্তানিরা আর দাঁড়াতে পারেনি। মুক্তিবাহিনী খুব সহজে ৯ ডিসেম্বরের মধ্যে ঢাকায় চলে আসতে পারে।

১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে লেফটেন্যান্ট থাকাবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন হেলাল মোর্শেদ খান।

মুক্তিযুদ্ধের ৩ নম্বর সেক্টরের এই সাব সেক্টর কমান্ডার স্বাধীনতার পর বীরবিক্রম খেতাব পেয়েছেন। ১৯৯৬ সালে কথিত অভ্যুত্থানের অভিযোগে মেজর জেনারেল থাকাবস্থায় অভিযুক্ত ও চাকরিচ্যুত হন তিনি।

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন হেলাল মোর্শেদ।

১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর চূড়ান্ত আক্রমণ হয় আখাউড়ার পাকিস্তানি প্রতিরক্ষাব্যুহে; সেই সময়ে মুক্তিবাহিনী মিত্র বাহিনীর সঙ্গে মিলে অগ্রাভিযানে ছিল বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে।

আখাউড়া ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১২ এফএফ ব্যাটালিয়নের একটি প্রতিরক্ষাস্থল। এটার সঙ্গে ‍যুক্ত হয়েছিল আজাদ কাশ্মির রাইফেলসের দুটি কোম্পানি। অর্থাৎ একটি ব্রিগেড শক্তির প্রায় অর্ধেক ছিল আখাউড়া পরিখা ডিফেন্সে।

রেললাইন এবং তার আশপাশের পারিপার্শ্বিক অবস্থানটি নিয়ে বিশাল এলাকা নিয়ে পরিখা খনন করে, অ্যান্টি পার্সোনাল মাইন লাগিয়ে ও কাঁটাতার দিয়ে একটি দুর্গের মতো গড়ে তোলা হয়েছিল প্রায় অর্ধমাইল এলাকাজুড়ে।

প্রতিরক্ষাস্থল ভেঙে দেওয়ার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে হেলাল মোর্শেদ খান বলেন, “এটি ছিল একটি চূড়ান্ত অবস্থান। সেটি যদি দখল হয়ে যায়, তাহলে এই ডিভিশনের এলাকাতে, অর্থাৎ ২৭ ব্রিগেড এলাকাটি তখন সম্পূর্ণ অরক্ষিত হয়ে যাবে।”

এই যুদ্ধটির জন্য প্রস্তুতি শুরু হয় অক্টোবরের শেষের দিক থেকে নভেম্বরের দিকে। নভেম্বর থেকে আক্রমণটি শুরু হয়। ধীরে ধীরে আক্রমণটিকে বেগবান করা হয়। চূড়ান্ত আক্রমণটি শেষ হয় ৫ ডিসেম্বরে।

সেই যুদ্ধের জন্য আখাউড়ার বিশাল এলাকাটিকে কয়েকটি ভাগ করা হয়। ১০ম বিহার রেজিমেন্ট ও চতুর্থ গার্ড রেজিমেন্ট আমাদের মিত্রবাহিনীর তারা বাঁ দিক থেকে। ডানদিক থেকে আক্রমণ করা হয় দ্বিতীয় ও ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট দিয়ে।

এই আখাউড়ার রেললাইনের উপরে ছিল মুক্তিবাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ানের সদর। এখানে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার ছিলেন মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী আর এস ফোর্সের কে এম সফিউল্লাহ ছিলেন সার্বিক কমান্ডার।

সর্বশেষ যুদ্ধ শুরু হয় ১ তারিখ থেকে। আক্রমণে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানি প্রথম আক্রমণটি পরিচালনা করে। তাদের সঙ্গে মিত্রবাহিনীর ডিভিশনাল পর্যায়ের গোলন্দাজ বাহিনীও যুক্ত হয়।

এটি চলতে থাকে ৪ ডিসেম্বর ভোর রাত পর্যন্ত। এই আক্রমণে প্রথমে মুক্তিবাহিনী আজাদ কাশ্মির ব্যাটালিয়নের একটি বড় অংশকে দখল করে নেয়।

এরপর পাকিস্তানিরা প্রধান প্রতিরক্ষায় ফিরে গেলে বাঁ দিক থেকে যখন মিত্রবাহিনীর আক্রমণটি রচনা করা হয়। তখন তারা পেছন দিক থেকে প্রতিরক্ষা ও পরিখার ভেতরে ঢুকে পড়ে।

ঢুকে পড়ার কারণে ডান দিক থেকে যেহেতু মুক্তিবাহিনী একটি অংশকে দখল করে ফেলেছি আর মিত্র বাহিনীও বাঁ দিক থেকে অংশ দখল করে ফেলেছে।

সবশেষে আক্রমণের পর ৫ তারিখ ভোর রাতে সমূলে উৎপাটন যায় পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা, যেটি ছিল তাদের ২৭ নম্বর ব্রিগেডের প্রধান প্রতিরক্ষা।

হেলাল মোর্শেদ বলেন, যুদ্ধের নিয়ম হলো, প্রতিরক্ষা ভেঙে গেলে পিছু হটে আবার শুরু করা। পাকিস্তানিরা পিছু হটার পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে সরে গিয়ে আবার ব্যুহ তৈরি করতে চাইলেও ব্যর্থ হয়।

পিছু হটার মাধ্যমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া দিক থেকে পাকিস্তানিরা আক্রমণের চেষ্টা করেছিল, বাঁ দিক থেকে মিত্র বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে পৌঁছে যায়। আর মুক্তিবাহিনীর ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সরাইল হয়ে ভৈরব ব্রিজে পৌঁছে যায়।

“যে কারণে তারা দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা শুরু করার চেষ্টা করেও সেটা করতে পারেনি। আমরা অগ্রাভিযান শুরু করি। এবং ৫-৯ তারিখের মধ্যে আমরা ভৈরব ব্রিজ বা মেঘনা নদীর তীরে পৌঁছে যাই”, বলেন হেলাল মোর্শেদ।

আখাউড়ার পরে আশুগঞ্জে একটা পাল্টা আক্রমণ করলেও তারা সফল হয়নি পাকিস্তানিরা। তাদের পাশ কাটিয়ে মেঘনা নদীর কোল ঘেষে চলে ডেমরার চলে আসে মুক্তি বাহিনী।

হেলাল মোর্শেদ বলেন, “এটি কেবল সম্ভব হয়েছিল আখাউড়া প্রতিরক্ষা ঘাঁটিটিকে সমূলে ধ্বংস করে দেওয়ার কারণে। তাদেরকে আর প্রতিরক্ষার সুযোগ না দেওয়ার জন্য। যদি তারা করতে পারত, তাহলে আমরা এত সহজে এত কাছাকাছি আসতে পারতাম না।

“সে কারণে আখাউড়া যুদ্ধের মিত্র বাহিনী, মুক্তিবাহিনী ও গেরিলাদের যে সম্মিলিত আক্রমণ সেটি একটি ইতিহাস হয়ে আছে।”