একাত্তরের সম্মুখ সমরে: টাঙ্গাইলের ‘অপারেশন বল্লা’

একাত্তরে দেশজুড়ে গেরিলা আক্রমণে স্বাধীনতার স্বপ্নকে যখন এগিয়ে নিচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধারা, টাঙ্গাইলের সখীপুর থেকে মধুপুর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে মুক্তাঞ্চল, তখনও কালিহাতি উপজেলার বল্লা ইউনিয়ন থেকে মাঝেমধ্যে হামলা করছিল পাকিস্তানিরা। সেপ্টেম্বরে দুঃসাহসিক এক অভিযানে মুক্তিযোদ্ধারা সেই ঘাঁটি দখল করে নেন।

মাসুম বিল্লাহ কাজি নাফিয়া রহমান ও সাজিয়া আফরিনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Dec 2017, 04:14 PM
Updated : 15 Dec 2017, 04:18 PM

সেপ্টেম্বরের ওই সময়ে কমান্ডার কাদের সিদ্দিকী ভারতে থাকায় সেই দায়িত্ব পালন করছিলেন আনোয়ার উল আলম শহীদ; স্বাধীনতার পর যিনি রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হন।

শহীদ ও তার সহযোদ্ধারা এক ‘সাঁড়াশি’ অভিযানে মুক্ত করেছিলেন বল্লা এলাকা। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের ৪৬তম বার্ষিকীর প্রাক্কালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেছেন সেই যুদ্ধের গল্প।

পরিকল্পনা

আনোয়ার উল আলম শহীদ বলেন, বল্লা অপারেশন ছিল কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তাঞ্চলকে নিরাপদ রাখতে ওই অপারেশনের বিকল্প ছিল না।

বহেরাতৈল এলাকায় ১২ নম্বর কোম্পানির কমান্ডার আলি হোসেন লাল্টু ও সহকারী কমান্ডার গোলাম সরোয়ারের সঙ্গে অভিযানের পরিকল্পনা নিয়ে ২২ সেপ্টেম্বর কথা হয় শহীদের।

চারানের উল্টো দিকে জোয়াইর গ্রামে ছিল চার নম্বর কোম্পানি। ওই দলটির কমান্ডার ফজলুর রহমানও আলোচনায় যোগ দেন।

সেদিনের কথা স্মরণ করে শহীদ বলেন, “আমার মনে হয়েছিল একটু ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করলেই অনায়াসে বল্লাকে শত্রুমুক্ত করা যাবে। আমি বাদে বাকি কমান্ডাররা ছিলেন সেনাবাহিনীর, আমার পরিকল্পনা বলার সাথে সাথে তারা রাজি হলেন।”

 

বল্লা বাজারের পাশে হাই স্কুলে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পের জন্য সমস্ত রসদ আসত কালিহাতি থেকে। রাতে সৈন্যরা রাজাকার বাহিনীর কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তা ধরে এসে ক্যাম্পে পৌঁছে দিয়ে যেত সেসব।

শহীদরা ঠিক করলেন, ২৩ তারিখ রাতে ১২ নম্বর কোম্পানির কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে হানাদারদের মত হেলমেট আর খাকি পোশাক পরানো হবে, যাতে পাকিস্তানিরা তাদের নিজেদের লোক বলে মনে করে।

তাদের পেছনে থাকবে কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক, যারা রাজাকারদের মত পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে যাবে। কালিহাতি থেকে রসদ এসেছে- এমন বুঝিয়ে পাকিস্তানিদের ধোঁকা দেওয়া হবে।

“সেদিন ছিল পূর্ণিমার খুব কাছাকাছি। অপারেশনের জন্য রাতের আঁধার ভালো হলেও ওইদিন চাঁদের আলো দরকার ছিল। আবছা আলোতে মুক্তিযোদ্ধাদের মিলিটারি সাজিয়ে পাকিস্তানিদের ধোঁকা দেওয়াটা সুবিধাজনক ছিল,” বলেন শহীদ।

ছদ্মবেশী মুক্তিযোদ্ধাদের বলে দেওয়া হয়েছিল, ২৩ তারিখ রাত ১০টার দিকে চারানে এসে তাদের কালিহাতি-বল্লা সড়কে উঠতে হবে।

একই সময়ে চার নম্বর কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা বল্লা বাজারের কাছাকাছি সুবিধাজনক স্থানে তিন ইঞ্চি মর্টার নিয়ে অবস্থান নেবেন। তারা লক্ষ্য রাখবেন, পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান শুনে আর সৈন্যদের রসদ নিয়ে আসতে দেখে ক্যাম্পের পাকিস্তানিদের প্রতিক্রিয়া কী হয়।

পাকিস্তানিরা ফাঁদে পা দিয়ে বাঙ্কার ছেড়ে উঠে এলে চার নম্বর কোম্পানি পেছন থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করবে। আর ১২ নম্বর কোম্পানির যোদ্ধারা রাস্তার পাশে অবস্থান নেবে, যাতে পাকিস্তানিরা পালানোর চেষ্টা করলে তাদের ঘায়েল করা যায়।

দুই দিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণের এই পরিকল্পনা কাজ করলে স্বেচ্ছাসেবকদের পাশের গ্রামে গিয়ে নিরাপদে অবস্থান নিতে বলা হয়।

আর যদি পাকিস্তানিরা ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান শুনেও উঠে না আসে, তাহলে চার নম্বর কোম্পানির অবস্থান থেকে তিন ইঞ্চি মর্টারের গোলা এমনভাবে ছোড়া হবে যাতে তা বাঙ্কারের ওপর গিয়ে পড়ে। তারপর শুরু করতে হবে এলএমজি ও রাইফেল থেকে গুলি।

শহীদ জানান, পরিকল্পনা শেষ করে তিনি অন্য কমান্ডারদের বলেছিলেন, পরদিন সকালে তিনি মুক্ত বল্লা বাজারে বসে চা খেতে চান।

উড়ল মুক্তির নিশান

পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৩ সেপ্টেম্বর রাত ১০টার পর যার যার জায়গায় অবস্থান নিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। আনোয়ারুল আলম শহীদ চার নম্বর কোম্পানির সঙ্গ বল্লা বাজারের কাছে অবস্থান নিলেন অপারেশন পুরোপুরি প্রত্যক্ষ করার জন্য।

“আমার সাথে থাকলেন কমান্ডার ফজলুর রহমান। আরও ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ফারুক আহমেদ, আবদুল মান্নান, মনিরুজ্জামান সানু, মতিউর রহমান মতি, লক্ষণ চন্দ্র বর্মণ- এরা।”

রাত ১১টার দিকে ছদ্মবেশ ধরে মুক্তিযোদ্ধারা এলেও পাকিস্তানিরা বাঙ্কার ছেড়ে উঠল না। প্রথম পরিকল্পনায় কাজ হল না।

এরপর দ্বিতীয় পরিকল্পনা অনুযায়ী তিন ইঞ্চি মর্টার থেকে শুরু হল গোলাবর্ষণ।

শহীদ বলেন, “সে সময় আমাদের এত দক্ষতা ছিল না যে মর্টার শেল একদম জায়গায় গিয়েই লাগবে। কিন্তু আশেপাশে পড়লে যে প্রচণ্ড আওয়াজ হয়, তাতেই ভয় ধরায়ে দেয়।”

মর্টার থেকে গোলা ছোড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিন দিক থেকে পাকিস্তানিরা গুলি শুরু করে। দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি গোলা বর্ষণ চলে প্রায় ১৫-২০ মিনিট। কিছুক্ষণ পর দেখা যায় পাকিস্তানিদের জবাব দুর্বল হয়ে এসেছে। রাত সাড়ে ১২টার দিকে একেবারেই থেমে যায় গোলাগুলি।

এরপর কমান্ডার ফজলুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে সেনা ক্যাম্পের ভিতরে যান শহীদ। সেখানে তারা কয়েকটি লাশ পরে থাকতে দেখেন।

শহীদের অনুমান, বাকি পাকিস্তানি সৈন্যরা রাস্তায় না উঠে অন্য কোনো পথ ধরে দূরের গ্রামে পালিয়ে গিয়েছিল। ফলে রাস্তার পাশে অবস্থান নেওয়া ১২ নম্বর কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা তাদের দেখতে পায়নি।

“স্কুলে ঢুকে যখন দেখলাম যে কয়েকটা ডেড বডি পড়ে আছে আর কয়েকজন আহত, তখন বুঝলাম যে আমাদের অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে। পাকিস্তানিরা যখন পরাজিত হয় এমন জোরে জয় বাংলা স্লোগান হয়, ওই গুলির আওয়াজের চেয়েও বেশি।”

সেই অপারেশনের পর বল্লায় মুক্তিবাহিনীর দুটি কোম্পানি একদম স্থায়ী করে দেওয়া হয়। সেখানে আর কখনও পাকিস্তানিরা ঢুকতে পারেনি।

শহীদ বলেন, “আমাদের মুক্ত এলাকায় আমরা পুরো নয় মাস জাতীয় পতাকা উড়িয়েছি। জনসভা করেছি... শত শত মানুষ এসেছে সেখানে। মুক্ত স্বাধীন এলাকা ছিল ওইটুকু।”