১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী প্রথমবারের মতো একযোগে ঢাকা ও চট্টগ্রামে পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর ঘাঁটিগুলোতে আক্রমণ করে; মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত শত্রুদের জ্বালানি সরবরাহের ডিপোগুলো।
একাত্তরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ৮০ থেকে ৮৫টি অপারেশন চালিয়েছিল, যার মধ্যে এক ডজন অপারেশনে অংশ নিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন ‘বীর উত্তম’ খেতাব।
বিজয়ের ৪৬তম বার্ষিকীতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর যুদ্ধ পরিচালনার গল্প শুনিয়েছেন ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ।
১৯৭১ সালে ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের বৈমানিক ছিলেন। ২৫ মার্চ রাতে বাংলার নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের ওপর অতর্কিত আক্রমণের পরই তিনি ঠিক করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে যাবেন। তখন ঢাকায়ই ছিলেন তিনি।
সাহাবুদ্দিনের ভাষ্যে, “২৫ মার্চ রাত ১০টার পরে কামানের গোলা, মেশিনগানের গুলির শব্দ, মানুষের চিৎকার-আহাজারি শুরু হয়ে গেল। ঢাকা শহর রক্তে লাল হয়ে গেল। তখনই ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মাধ্যমে আমাদের সিদ্ধান্ত আমরা নিয়ে ফেলেছি, আমাদের যুদ্ধে যেতে হবে। নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালিদের উদ্ধার করতে হবে এ বর্বর পাকিস্তানিদের কাছ থেকে।”
২৭ মার্চ কারফিউ উঠে যাওয়ার পর তিনি মা-বাবাসহ পরিবারের সদস্যদের ঢাকার বিক্রমপুরের রায়পাড়া গ্রামে রেখে আসেন।
এরপর সিলেটের সাজিবাজারে একটি ‘ইলেকট্রিক্যাল প্ল্যান্ট’ উড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে তার ওপর। এজন্য তাকে কলকাতা থেকে আগরতলা যেতে হয়েছিল। তবে পরবর্তীতে তিতাস গ্যাসের এক ইঞ্জিনিয়ার সেই প্ল্যান্টের ইলেকট্রিক্যাল ইন্সটলেশন বন্ধ করে দেওয়ায় সেই অপারেশনের আর প্রয়োজন পড়েনি।
এরই মধ্যে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের (পিইএ) আরও কিছু বৈমানিক সীমান্ত পেরিয়ে আগরতলায় চলে আসলে তারা ভারত সরকারের কাছে কিছু বিমান চেয়ে প্রস্তাব দেন।
যেভাবে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী
সাহাবুদ্দিন আহমেদ বলেন, “ভারত সরকারের কাছে প্রস্তাব দেওয়া হলো যে, আমাদের এমন প্লেন দেওয়া হোক, যেটা মাঠে নামতে পারে, পানিতে নামতে পারে। আমরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থেকে পাকিস্তানি বিভিন্ন স্থাপনার ওপর আক্রমণ করব, যেন ভারতকে কোনো আন্তর্জাতিক জটিলতায় যেতে না হয়।
“তখন ভারত সরকার বাংলাদেশকে সাহায্য করছে এবং কূটনৈতিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের পক্ষে তখন ছিল শুধুমাত্র ভারত আর সোভিয়েত রাশিয়া। সেখানে ভারত যদি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তখন পাকিস্তানকে সাহায্য করবে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো, আমেরিকাসহ সবাই।”
মূলত এমন চিন্তাতেই বাংলাদেশের ভেতর থেকেই আক্রমণ চালানোর পরিকল্পনা ছিল।
সাহাবুদ্দিন জানান, ভারত সরকার তাদের প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে তাদের ডেকে পাঠায় দিল্লিতে। পরে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এ প্রস্তাব নিয়ে আসার জন্য বলা হয় তাদেরকে।
তখন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ ও গ্রুপ ক্যাপ্টেন এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের অক্লান্ত পরিশ্রমে গঠন হলো বাংলাদেশ বিমানবাহিনী।
“ভারতের যোধপুরের মহারাজা তাদের একটি ড্যাকোটা বিমান দিয়েছিলেন। ভারতীয় বিমানবাহিনী একটি কানাডিয়ান অর্টার প্লেন এবং একটি ফ্রেঞ্চ হেলিকাপ্টার দিয়েছিল। যেগুলোর কোনোটাই যুদ্ধ বিমান ছিল না। এগুলো সমর সাজে সজ্জিত করা হয়েছিল। এ সময়ে ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল পি সি লাল বিমানবাহিনী গঠনের জন্য তাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছিলেন।”
একাত্তরের ২৮ সেপ্টেম্বর এয়ার চিফ মার্শাল পি সি লাল এবং এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার ভারতের দিমাপুরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।
সাহাবুদ্দিন আহমদ বলেন, “তখন সেখানে আমরা নয়জন পাইলট ছিলাম। তার মধ্যে ছয়জনই ছিল বেসামরিক পাইলট। আমাদের কারও যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ছিল না। তিনজন ছিলেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর। তারা হলেন এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ বীর উত্তম, ফ্লাইট লে. শামসুল আলম এবং ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম।”
এরপর শুরু হলো সামরিক প্রশিক্ষণ। নাগাল্যান্ড, মনিপুর, ত্রিপুরা ও আসামের জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ি এলাকায় তারা প্রশিক্ষণ ও মহড়া চালাতেন।
সেই সময়ের রোমন্থনে এ বৈমানিক বলেন, “নাগাল্যান্ডের চারিদিকে উঁচু পাহাড় আর জঙ্গল। এর ভিতরেই আমরা প্রশিক্ষণ শেষ করলাম। আমরা ২০০-২৫০ ফিটের উপরে প্লেন চালাতাম না কারণ বাংলাদেশের আকাশে এর চেয়ে বেশি উচ্চতায় উড়লে, পাকিস্তানি রাডারে ধরা পড়বে প্লেন।
“একটু মেঘ হলে নাগাল্যান্ডের পাহাড়গুলি আর কিছু দেখা যেত না। তাই ওই সময়ে প্রশিক্ষণটা খুব বিপদজনক ছিল। আমাদের প্রশিক্ষণের সময় অনেক দুর্ঘটনার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু আমরা ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছি।”
শুরু হলো যুদ্ধ
অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে তাদের প্রশিক্ষণ শেষ হলো। ৩ নভেম্বর ঢাকা ও চট্টগ্রামে তাদের আক্রমণের পরিকল্পনা থাকলেও তা স্থগিত করা হয়।
এ প্রসঙ্গে ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিনে বলেন, “সে সময়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে গিয়েছিলেন তাদের বুঝানোর জন্য যে, তার দেশে এক কোটি শরণার্থী রয়েছে এবং এদের ব্যয়ভার অনির্দিষ্টকালের জন্য বহন করা তার জন্য কষ্টকর। এছাড়াও বাংলাদেশিরা যেন স্সম্মানে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে, সেই নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য। এ কারণেই যুদ্ধটি ‘হোল্ড’ করা হয়েছিল।
“আমরা তখন বিমর্ষ হয়ে গেলাম যে, আমরা দেশ থেকে পাকিস্তানি বর্বরদের তাড়াব, এটা বিলম্বিত হওয়ায়।”
অবশেষে ৩ ডিসেম্বর রাত ১২টা ০১ মিনিটে তৎকালীন উইং কমান্ডার সুলতান মাহমুদ ও স্কোয়াড্রন লিডার বদরুল আলম হেলিকাপ্টার নিয়ে ঢাকার নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর জ্বালানি ডিপোতে এবং ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট শামসুল আলম ও ক্যাপ্টেন আকরাম রাত ১২টা ১০ মিনিটে অর্টার দিয়ে চট্টগ্রামে জ্বালানি তেলের আরেক ডিপোতে আক্রমণ করেন।
বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রথম আক্রমণের পরই ভারতীয় বিমানবাহিনীও বাংলাদেশের প্রধান প্রধান বিমানবন্দরগুলোতে আক্রমণ শুরু করে।
প্রথম অপারেশন ভালোভাবে উতরাতে পারলেও পরেরগুলো মোটেও সহজ ছিল না বলে জানান সাহাবুদ্দিন।
“৩ ডিসেম্বরের অপারেশন পরিচালনা করে নির্বিঘ্নে আমরা চলে আসতে পেরেছিলাম। কিন্তু পরবর্তী সব আক্রমণ ছিল অনেক বিপদজনক। পাকিস্তানিদের ছোড়া বুলেটগুলো আমাদের হিট করতে পারত কিন্তু ভাগ্যক্রমে করেনি। আমাদের প্লেনগুলো ফুটো হয়ে গিয়েছিল।”
বিমানের সাথে সজ্জিত রকেটগুলো বৈমানিক নিজেই ‘ডিসচার্জ’ করতেন। সাথে থাকা আরেক বৈমানিক তাকে ‘নেভিগেশনে’ সহায়তা করতেন।
“আমরা অপারেশনে থাকাকালীন কোনো পাকিস্তানিদের দেখলে, তাদের কনভয় দেখলে ফিরে এসে বলতাম অন্যদের। তখন তারা আবার আরেকটি বিমান নিয়ে আক্রমণে চলে যেত।
বিমানবাহিনীর আক্রমণের ফলেই পাকিস্তানি বাহিনী দ্রুত পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল বলে মনে করেন ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন।
“আমাদের আক্রমণের ফলে পাকিস্তানিরা খুব দ্রুত ‘রিট্রিট’ করছিল। ওরা দাঁড়াতে পারছিল না। আর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী দ্রুত আগাচ্ছিল। যেখানে সাতদিন সময় লাগত, সেখানে দুই বা তিনদিনে মুক্তিবাহিনী অগ্রসর হতে পারত।”
সাহাবুদ্দিন জানান, ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিমানবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি ও কনভয়ের ওপর আক্রমণ করে নানাভাবে তাদের ক্ষতিসাধন করেছে। তারা পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ করত আর বিভিন্ন ঘাঁটি দখল করত মুক্তিবাহিনী।
বিমান হামলার মুখে ১২ ডিসেম্বর সকালে নরসিংদী শত্রুমুক্ত হলে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী চারদিক থেকে ঢাকাকে ঘিরে ফেলে।
যুদ্ধ সময়ের স্মৃতির বর্ণনায় ছল ছল চোখে ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন বলেন, “পাকিস্তানিদের মতো বর্বর নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আর নেই। তারা আমাদের লাখ লাখ জনসাধারণকে নির্বিচারে হত্যা করেছে। ওদের বাংলার মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন করে নিরীহ জনগণকে উদ্ধার করা, মা-বোনকে উদ্ধার করাই ছিল আমাদের একমাত্র লক্ষ্য।
“বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর আক্রমণেই আমাদের বিজয়টা তরান্বিত হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধারা যেখানেই বাধার সম্মুখিন হয়েছে, আমরা সেখানেই তাদের সহযোগিতা করেছি।”
যুদ্ধের বর্ণনা দিতে গিয়ে ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন বার বার স্মরণ করছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে।
“ইন্দিরা গান্ধীর একাগ্রতার জন্যেই এতো কম সময়ে আমরা যুদ্ধে জয়লাভ করেছি। নইলে কোনোভাবেই তা সম্ভব হতো না।
যুদ্ধে সাধারণ মানুষ ও নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের প্রসঙ্গে এ মুক্তিযোদ্ধা বলেন, “বাংলাদেশের রাজাকার আর আলবদররা ছাড়া সবাই মুক্তিযোদ্ধা। এই জনগণ যে কীভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছে তা বলে বোঝানো যাবে না। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে, তাদের সাহায্য করতে গিয়ে মারা গেছে অগণিত মানুষ।”
এক নারী মুক্তিযোদ্ধার কথা তুলে ধরে বলেন, “এক নারী তার চুল কেটে ছেলে সেজে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, কেননা মেয়ে জানলে তাকে নেওয়া হবে না। কারণ মুক্তিযোদ্ধারা চাইত না, একজন নারী যুদ্ধে আঘাত পাক, শহীদ হোক। পরবর্তীতে সবাই জেনেছে, কিন্তু তাকে আর কেউ না করেনি।
“মুক্তিযুদ্ধের সময় তারামন বিবি পাকিস্তানিদের রান্না করে দিয়ে আসত আর তাদের সব তথ্য দিত মুক্তিযোদ্ধাদের। নাম না জানা এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধার অবদানে আমরা আজ স্বাধীন।”