দুদকের লক্ষ্য এবার কোচিং সেন্টারের মালিকরা

প্রশ্ন ফাঁস, নোট-গাইড, কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নির্মাণ, এমপিওভুক্তি, নিয়োগ ও বদলির ক্ষেত্রে দুর্নীতি রুখতে সরকারকে ৩৯ দফা সুপারিশসহ প্রতিবেদন দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন।

তাবারুল হক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Dec 2017, 02:13 PM
Updated : 13 Dec 2017, 02:28 PM

যে সব শিক্ষক অবৈধভাবে কোচিং করিয়ে সম্পদ অর্জন করেছেন এবং কোচিং সেন্টারের মালিকদের অবৈধ সম্পদ খতিয়ে দেখার ঘোষণা দিয়েছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি। পাশাপাশি নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষকদের বদলি নিশ্চিত করা এবং ডিসেম্বরে নোট-গাইড প্রকাশনা সংস্থাগুলোতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালানোর কথা বলা হয়েছে।

প্রশ্ন ফাঁস রোধসহ শিক্ষার মানোন্নয়নে পরীক্ষায় বহু নির্বাচনী প্রশ্ন সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে বর্ণনামূলক, সৃজনশীল ও বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্ন করার সুপারিশ করেছে দুদক।

সংস্থাটির উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) প্রনব কুমার ভট্টাচার্য জানান, কমিশনের সচিব মো. শামসুল আরেফিন স্বাক্ষরিত এই সুপারিশমালা বুধবার মন্ত্রিপরিষদ সচিব বরাবর পাঠানো হয়েছে।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কমিশনের ‘শিক্ষা সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক টিমের’ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ওই ৩৯টি সুপারিশ করা হয়েছে সরকারকে।

ফাইল ছবি

শিক্ষা সচিব, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক  বোর্ডের চেয়ারম্যান, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীকেও সুপারিশগুলো পাঠানো হবে বলে জানান প্রনব।

শিক্ষা সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক দলের ওই অনুসন্ধানের নেতৃত্বে ছিলেন দুদক পরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীন।

প্রশ্নপত্র ফাস:

প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাবলিক পরীক্ষার মাধ্যমেই রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে কিশোরদের প্রথম পরিচয় হয়। প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে সেখানেই তারা দুর্নীতির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে।

পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসকে ‘দুর্নীতির নতুন সংযোজন’ হিসেবে বর্ণনা করে এতে বলা হয়, “অবৈধ অর্থের বিনিময়ে কতিপয় দুর্নীতিপরায়ন সরকারি কর্মকর্তা এ জাতীয় অপরাধের সঙ্গে জড়িত।”

প্রশ্ন ফাঁসের সম্ভাব্য উৎস সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষা বোর্ড, বাংলাদেশ সরকারি প্রেস (বিজি প্রেস), ট্রেজারি ও পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে।

“এসব প্রতিষ্ঠানের অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে কোচিং সেন্টার, প্রতারক শিক্ষক ও বিভিন্ন অপরাধী চক্রও যুক্ত থাকতে পারে।”

প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটিতে বাছাই করে মেধাবীদের নিয়োগ দেওয়ার পাশাপাশি প্রশ্ন প্রণয়ন ও বিতরণে দায়িত্বপ্রাপ্তদের অঙ্গীকার নেওয়া, মডারেটরসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কঠোর নজরদারিতে রাখা, প্রতিটি উপজেলায় সর্বোচ্চ দুটির বেশি পরীক্ষা কেন্দ্র না রাখা, প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে পাবলিক পরীক্ষা আইন, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা বা তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে মামলা দায়ের করার কথা বলা হয়েছে দুদকের সুপারিশে।

গত কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের খবর সংবাদ মাধ্যমে এলেও এবার এর ব্যাপকতা পৌঁছেছে প্রাথমিক স্তরেও।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নানা উদ্যোগের পরও অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জেএসসি এবং পঞ্চমের পিইসিতে অনেক বিষয়ের প্রশ্ন পরীক্ষা শুরুর আগেই চলে এসেছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে।

প্রাথমিক সমাপনীর শেষ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নও পরীক্ষার আগে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রলোভন দেখানো হয়েছে একটি ফেইসবুক পেইজে।

নুরুল ইসলাম নাহিদ দাবি করে আসছেন, প্রশ্নপত্র ছাপানোর স্থান বিজি প্রেস থেকে এখন আর ফাঁসের সুযোগ নেই। এত চেষ্টার পরও প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে না পেরে তিনি দুষছেন শিক্ষকদের।

কোচিং ও নোট-গাইড বাণিজ্য:

কোচিং মালিক ও কিছু শিক্ষকের অবৈধভাবে স্বল্প সময়ে সম্পদ অর্জনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা, শিক্ষা কার্যক্রমের মনিটরিংয়ের অভাব এবং অভিভাবকদের অসচেতনতার কারণে কোচিং ও নোট-গাইড বাণিজ্যের মাধ্যমে দুর্নীতি হচ্ছে বলে পর্যবেক্ষণ দুদকের।

এই সমস্যার সমাধানে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান নিশ্চিত করতে নগর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষা মনিটরিং কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

এছাড়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বদলির নীতিমালা অনুসারে বদলি নিশ্চিত করা, শিক্ষকদের প্রশাসনিক কোনো পদে পদায়ন না করা, ঢাকার কোনো প্রতিষ্ঠান কোনো শিক্ষক তিন বছর চাকরি করলে তাকে আর এই শহরের বাইরের প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে দেওয়া, বিষয়ের বাইরে ক্লাস না নেওয়া নিশ্চিত করা এবং গ্রামের স্কুলগুলোতে শিক্ষকের স্বল্পতা দূর করতে ব্যবস্থা  নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে বহু নির্বাচনী প্রশ্নপত্র সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া প্রয়োজন এবং প্রশ্ন বর্ণনামূলক, সৃজনশীল ও বিশ্লেষণধর্মী করতে বলা হয়েছে।

কোচিং বাণিজ্য বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছে ছাত্র সংগঠনগুলো (ফাইল ছবি)

কোচিং নীতিমালার বাইরে যে সব শিক্ষক কোচিং করাচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী অভিভাবকদের সম্মতিতে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের কোচিং করানোর সুযোগ রয়েছে। কিন্তু ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে কিছু শিক্ষক ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষার্থীদের পড়িয়ে মাসে লাখ লাখ টাকা আয় করছেন।

কোচিং ও কোচিং সেন্টার বন্ধ করা প্রয়োজন উল্লেখ করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “সকল কোচিং সেন্টারের মালিক বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, যারা অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন তাদের বিষয়গুলো দুদক খতিয়ে দেখবে।”

প্রতিবছরের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই সব নোট-গাইড প্রকাশনা সংস্থায় মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা কথাও বলা হয়েছে সুপারিশে।

এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান:

জাতীয় শিক্ষক নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) মাধ্যমে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়েছে। শিক্ষক নিয়োগে পিএসসির আদলে কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছে দুদক।

এছাড়া বর্তমানে এমপিওভুক্তি বিকেন্দ্রীকরণের কারণে দুর্নীতি কিছুটা কমলেও এক্ষেত্রে নজরদারি প্রয়োজন বলে মনে করছে দুদক।

প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু বিকেন্দ্রীকরণ নয়, নিয়মিত মনিটরিং করা প্রয়োজন। যে সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর এ সব কাজে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়ন নীতিমালা অনুসরণ, তিন বছরের বেশি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন দপ্তর, অধিদপ্তর ও সংস্থা থেকে বদলি এবং শিক্ষকদের পেনশন আবেদনের সাথে সাথেই পেনশন প্রাপ্তির দিন-ক্ষণ জানিয়ে দিতে সুপারিশ করা হয়েছে।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড:

এনসিটিবির কার্যক্রম স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন রাখতে দুদকের সুপারিশে বলা হয়, এর দরপত্র প্রক্রিয়ায় ‘ই-টেন্ডারিং’ করা প্রয়োজন। টেন্ডার প্রক্রিয়া দুর্নীতির একটি বড় উৎস। কোনো কর্মকর্তা যদি নামে বা বেনামে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে দরপত্র অংশগ্রহণ করেন, তবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। লেখক কমিটি, শিক্ষা উন্নয়ন কমিটি ও টেকনিক্যাল কমিটিতে মেধাবী ও যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে হবে।

এছাড়া শিক্ষাক্রম ও পাণ্ডুলিপি প্রণয়নের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের সুপারিশ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, বইয়ের পাণ্ডুলিপি যখন এনসিটিবি প্রেসে পাঠানো হয়, ঠিক একই সময়ে এনসিটিবির অসাধু কর্মকর্তাদের মাধ্যমে নোট-গাইড প্রকাশকদের কাছে চলে যায়। এজন্য কঠোর মনিটরিং দরকার।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়:

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কাজ নিয়ে সমালোচনা করা হয়েছে দুদকের প্রতিবেদনে।

এতে বলা হয়, নিয়ম অনুসারে নথি নিষ্পত্তি না করে তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে বিষয় নিষ্পত্তিতে বিলম্ব ঘটিয়ে দুর্নীতির পথ সৃষ্টি করা হয়। এ সব কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

এছাড়া বিভিন্ন প্রকল্পের গাড়ির অবৈধ ব্যবহার বন্ধ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পরিচালিত প্রকল্পগুলোর বিভিন্ন ক্রয়, গাড়ি ব্যবহার, অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণ, প্রশিক্ষণের নামে অর্থ ব্যয়ে অনিয়মের যে সব অভিযোগ রয়েছে তা দূর করতে উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে।

অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্মত উচ্চ শিক্ষা নিশ্চিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন- ২০১০ অনুসারে শর্তপূরণে ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা সংক্রান্ত সব কার্যক্রম বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।