স্ত্রীকে রাহমানীর বই পড়ার পরামর্শ দিতেন আকায়েদ: পুলিশ

নিউ ইয়র্কে আত্মঘাতী হামলার চেষ্টার ঘটনায় গ্রেপ্তার বাংলাদেশি তরুণ আকায়েদ উল্লাহ তার স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসকে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান সংগঠক মুফতি জসীমউদ্দীন রাহমানীর বই পড়ার পরামর্শ দিতেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Dec 2017, 08:48 AM
Updated : 13 Dec 2017, 05:17 PM

আকায়েদের স্ত্রী ও শ্বশুর-শাশুড়িকে মঙ্গলবার জিজ্ঞাসাবাদের পর বুধবার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম।

তিনি বলেন, সাত বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার আগে আকায়েদের কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছিল কি না- সে বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের মত বাংলাদেশের পুলিশেরও ধারণা, যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমেই আকায়েদ উগ্রবাদে ঝুঁকেছেন।

এই তদন্তে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করতে বাংলাদেশের পুলিশ প্রস্তুত বলেও মন্তব্য করেন মনিরুল।

নিউ ইয়ার্কের ম্যানহাটনে বাস টার্মিনালের ব্যস্ত এলাকায় সোমবার সকালে বিস্ফোরণের পর আকায়েদকে আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার করে হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশ।

যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, আকায়েদ তার দেহের সঙ্গে বাঁধা বিস্ফোরকে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন। তাদের ধারণা, আইএসের মত কোনো জঙ্গি গোষ্ঠীর মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়ে আকায়েদ ওই ঘটনা ঘটিয়েছেন।

চট্টগ্রামের আকায়েদ বড় হয়েছেন ঢাকার হাজারীবাগে। সাত বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর প্রথমে ট্যাক্সিক্যাব চালালেও পরে একটি আবাসন নির্মাতা কোম্পানিতে বিদ্যুৎ মিস্ত্রির কাজ নেন।

২৭ বছর বয়সী ওই তরুণের বিরুদ্ধে মঙ্গলবার নিউ ইয়র্কের আদালতে বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠনকে সহায়তা, জনসমাগমস্থলে বোমা হামলা, ধ্বংসাত্মক ডিভাইস ও বিস্ফোরক ব্যবহার করে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির অভিযোগ দায়ের করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের তদন্তকারীরা।

নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনে বাস টার্মিনালে বিস্ফোরণের পর সেখানে পুলিশের তৎপরতা- ছবি: রয়টার্স

ম্যানহাটন ফেডারেল আদালতে ওই লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, হামলার কিছুক্ষণ আগে ফেইসবুকে এক পোস্ট দিয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন আকায়েদ।

এসব অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হলে বাকি জীবন কারাগারেই কাটতে হতে পারে আকায়েদকে।

ম্যানহাটনে বিস্ফোরণের ঘটনার পর আকায়েদ সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্যরা জিগাতলার মনেশ্বর রোডে তার শ্বশুড়বাড়ির ঠিকানা পান।

পরে আকায়েদের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস, শ্বশুর জুলফিকার হায়দার ও শাশুড়ি মাহফুজা আকতারকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

মনিরুল বলেন, আকায়েদ সর্বশেষ দেশে এসেছিলেন গত সেপ্টেম্বরে তার সন্তানের জন্মের সময়।

“জিজ্ঞাসাবাদে তারা বলেছেন, দেশে অবস্থানকালে অধিকাংশ সময় আকায়েদ তার স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে কাটিয়েছে। সে তার স্ত্রীকে নিয়মিত জসীমউদ্দীন রাহমানীর বই পড়ার পরামর্শ দিত। তবে তার বাসায় রাহমানীর বইপত্র পাওয়া যায়নি।”

২০১৩ সালে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যাকাণ্ডের পর আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের তৎপরতার খবর আলোচনায় আসে। সংগঠনটির আমির রাহমানী ওই মামলার রায়ে দোষি সাব্যস্ত হয়ে কারাভোগ করছেন।

২০১৫ সালের মে মাসে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নিষিদ্ধ হওয়ার পর এর সদস্যরা আনসার আল ইসলাম নামে তৎপরতা শুরু করলে চলতি বছর মে মাসে এ সংগঠনকেও নিষিদ্ধ করা হয়।

লেখক অভিজিৎ রায় হত্যাসহ বেশ কয়েকটি জঙ্গি হামলা ও হত্যার ঘটনায় আনসারুল্লাহ ও আনসার আল ইসলাম জড়িত বলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভাষ্য।

আকায়েদ উল্লাহ, ছবি: রয়টার্স

২০১১ সালে ফ্যামিলি ভিসায় পরিবারের সবার সঙ্গে নিউ ইয়র্কে যাওয়ার পর আকায়েদ তার বাবা, মা ও ভাই-বোনদের সঙ্গে ব্রুকলিনে বসবাস করে আসছিলেন। ওই পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের নিউ ইয়র্ক প্রতিনিধিকে বলেছেন, বাংলাদেশে থাকার সময় ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাংগঠনিক তৎপরতায় জড়িত ছিলেন আকায়েদ। তবে যুক্তরাষ্ট্রে জামায়াত-শিবিরের সমর্থকদের নিয়ে গঠিত সংগঠনগুলোর সঙ্গে আকায়েদকে তেমনভাবে দেখা যায়নি।

এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে মনিরুল ব্রিফিংয়ে বলেন, “আকায়েদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নিয়ে এখনো নিশ্চিত কোনো তথ্য হওয়া যায়নি। সে কীভাবে উগ্রবাদে জড়িয়েছে, তা দেখা হচ্ছে।

“ তবে তার শ্বশুর-শাশুড়ি এবং স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে যতটা বুঝতে পেরেছি, আমেরিকায় গিয়েই ইন্টারনেট থেকে সে র‌্যাডিক্যালাইজড হয়েছে; অর্থাৎ সেলফ র‌্যাডিক্যালাইজড।”

দেশে এসে ওই তরুণ যাদের সঙ্গে মিশতেন, তাদের সম্পর্কেও পুলিশ তথ্য সংগ্রহ করছে জানিয়ে মনিরুল বলেন, “এখানে তার চেনা-পরিচিতদের মধ্যে র‌্যাডিক্যালাইজড হয়েছে- এমন কারও তথ্য আমাদের অনুসন্ধানে পাওয়া যায়নি।”

এর আগে বাংলাদেশের পুলিশ প্রধান এ কে এম শহীদুল হক বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছিলেন, দেশে আকায়েদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার কোনো রেকর্ড নেই।

ওই তরুণের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস এবং শাশুড়ি মাহফুজা আকতারও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে দাবি করেছেন, আকায়েদের মধ্যে জঙ্গিবাদি কোনো লক্ষণ তারা আগে দেখেননি।

আহত আকায়েদকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে ম্যানহাটনের বেলভিউ হাসপাতালে। সেখানে তার বক্তব্য থেকে উদ্ধৃত করে নিউ ইয়র্ক পুলিশের কমিশনার জেমস ও’নিল সাংবাদিকদের বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে জেরুজালেমকে স্বীকৃতি দেওয়ায় ক্ষোভ থেকে সে ওই ঘটনা ঘটায়।

অক্টোবর নিউ ইয়র্কের রাস্তায় পথচারীদের ওপর ট্রাক উঠিয়ে আটজন হত্যার ঘটনায় যে উজবেক অভিবাসীকে দায়ী করা হয়, আকায়েদও তার মত জিহাদি কোনো গোষ্ঠীর প্রভাবে একাকী হামলা চালানোর পথ বেছে নিয়ে থাকতে পারেন বলে মনে করেন নিউ ইয়র্কের গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমো।

তিনি বলেন, “তারা দুজনেই ইন্টারনেট থেকে তথ্য নিয়েছে। আকায়েদ ওইভাবেই বোমা বানানো শিখেছে।… তারা বিদেশ থেকে আসেনি, তারা এখানেই বসবাস করত।”