হলি আর্টিজান মামলার অভিযোগপত্র এ মাসেই: মনিরুল

গুলশানের হলি আর্টিজান মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে জানিয়ে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, ডিসেম্বরের মধ্যেই এ মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া সম্ভব হবে বলে তারা আশা করছেন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Dec 2017, 01:28 PM
Updated : 22 March 2018, 11:50 AM

রোববার দুপুরে ঢাকায় পুলিশের গণমাধ্যম কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে হলি আর্টিজান হামলার তদন্ত এবং  ব্লগার ও প্রকাশক হত্যা মামলার সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে কথা বলেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।

শুরু থেকে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের নেতৃত্ব দিয়ে আসা মনিরুলকে সম্প্রতি ‘এন্টি টেররিজম ইউনিট’ নামে পুলিশের নবগঠিত ইউনিটে বদলি করা হলেও এখনও তিনি সেখানে যোগ দেননি। হলি আর্টিজান মামলার তদন্তের দায়িত্বে থাকা কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান হিসেবেই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন পুলিশের এই ডিআইজি।   

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে কূটনীতিক পাড়া গুলিশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালিয়ে ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনকে হত্যা করে জঙ্গিরা। তাদের ঠেকাতে গিয়ে দুই পুলিশ কর্মকর্তাও নিহত হন।

ওই ঘটনায় গুলশান থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইন, হত্যাকাণ্ড ও তথ্য গোপনের অভিযোগে তিনটি মামলা করে পুলিশ। এরপর গত দেড় বছরেও পুলিশ তদন্ত শেষ করতে পারেনি।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মনিরুল বলেন, “হলি আর্টিজান মামলার অভিযোগপত্র এ মাসেই দাখিলের চেষ্টা করব।”

গত জুলাইয়ে ওই হামলার বর্ষপূর্তির সময় তদন্তকারীরা বলেছিলেন, কয়েকজন সন্দেহভাজন জঙ্গি গ্রেপ্তার না হওয়ায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলার তদন্ত আটকে আছে। রোববার মনিরুলও একই কথা বলেন।

“তদন্ত অনেক আগেই শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেলেও কিছু আসামি নিয়ে কনফিউশন ছিল। যেমন বাশারুজ্জামান চকলেট, ছোট মিজান। এরা মামলায় সন্দেহভাজন হলেও পলাতক ছিল। চাঁপাইনবাবগঞ্জে কিছুদিন আগে এক অভিযানে নিহতদের চেহারার সঙ্গে চকলেট ও ছোট মিজানের মিল পাওয়া যায়। পরে ডিএনএ পরীক্ষায় সেটা মিলে যায়। তারা নিহত হয়েছে এটা এখন নিশ্চিত করে বলা যায়।”

তদন্ত করতে গিয়ে ওই ঘটনায় যাদের জড়িত থাকার তথ্য পুলিশ পেয়েছে, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ধরা পড়েছেন এবং কয়েকজন নিহত হয়েছেন। গ্রেপ্তারদের কেউ কেউ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। কিন্তু হাদিসুর রহমান সাগর নামে এক আসামি এখনও পলাতক বলে জানান মনিরুল।

মামলার তদন্তে আরও কয়েকজনের নাম এসেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “হামলার অর্থ যোগানদাতা হিসেবে আকরাম হোসেন নামে একজনের নাম এসেছে, যাকে খোঁজা হচ্ছে। গত ১৫ অগাস্ট পান্থপথে হোটেল ওলিওতে হামলার ঘটনাতেও পৃষ্ঠপোষক ও নির্দেশদাতা হিসেবে তার নাম পাওয়া গেছে।”

মনিরুল বলেন, হলি আর্টিজান হামলার আগে জঙ্গিদের একটি বৈঠক হয়েছিল, সেখানে রিপন ও ঢালি নামে আরও দুজন উপস্থিত ছিলেন বলে তদন্তে উঠে এসেছে।

“তাদের বড় ভূমিকা না থাকলেও ইন্ডিয়ায় পলাতক থেকে তারা অনুপ্রেরণা দিয়েছে। এদের গ্রেপ্তার করতে পারলে জবানবন্দি নেওয়া সম্ভব হবে। গ্রেপ্তার করতে না পারলেও এ মাসেই অভিযোগপত্র দাখিলের চেষ্টা করব আমরা।”

সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, হলি আর্টিজান হামলায় জড়িত পাঁচজনকে এ পর্যন্ত জীবিত গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে। তাদের মধ্যে মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে ‘রাজীব গান্ধী’, রাশেদুল ইসলাম রাশেদ ওরফে র‌্যাশ ও রাকিবুল হাসান রিগান আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

গ্রেপ্তার অপরজন জেএমবির অন্যতম শীর্ষনেতা সোহেল মাহফুজ গুলশান হামলার গ্রেনেড সরবরাহ করেছিলেন বলে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে।

এছাড়া সেই রাতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে হলি আর্টিজানে আটকে থাকা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আবুল হাসনাত রেজাউল করিমও কারাগারে আছেন।

“সাক্ষী হিসেবে তানভীর কাদেরীর ছেলে ও স্ত্রী ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। সন্দেহভাজন আসামিদের মধ্যে বাশারুজ্জামান চকলেট, তামিম চৌধুরী, ছোট মিজানসহ যারা মারা গেছেন, চার্জশিটে তাদের দায় দায়িত্ব উল্লেখ করা হবে। তবে মৃত্যু হওয়ায় তাদের নাম বাদ দেওয়ার আবেদন করা হবে।”

হলি আর্টিজান হামলার পেছনে কারা ছিল- এ প্রশ্নে মনিরুল বলেন, “মূল মাস্টারমাইন্ড ছিল তামিম চৌধুরী। তার সহযোগী ছিলেন সারোয়ার জাহান, পলাতক মেজর জাহিদ। এরা মূলত আইএসের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিলেন। তবে তা আইএস এর সরাসরি কোনো অপারেশন নয়। তদন্তে ঘটনার সঙ্গে আইএসের কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি।”

হামলার কারণ সম্পর্কে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “এ ধরনের ঘটনার আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল সরকারকে বেকায়দায় ফেলা। ফরেন ইনভেস্টমেন্ট যেন ক্ষতিগ্রস্ত হয়- সেজন্য বিদেশিদের হত্যা করা। অর্থাৎ, সরকার যেন অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, মানুষ যেন প্রচণ্ডভাবে সরকারের ওপর থেকে আস্থা হারায়, সন্ত্রাস দমন করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে- এমন বার্তা দেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যাতে চলে যায়। তারা ভেবেছিল- এমন আরও দুই একটা হামলা করলে সরকার পদত্যাগে বাধ্য হবে এবং তাদের অনুকূলের একটা সরকার আসবে।”

মনিরুল বলেন, এ সরকারকে যারা রাজনৈতিকভাবে হটাতে চায়, তারা জঙ্গিদের ‘ন্যাচারাল অ্যালাই।’

“সরকারকে হটাতে পারলে তারাও লাভবান হবে। এজন্য তাদের মৌন সমর্থনও ছিল। এজন্য আমরা তদন্তে দেখেছি- ঘটনার পর অনেকে বিবৃতি দিয়ে বলেছে যে সরকার ব্যর্থ হয়েছে।… আমরা দেখেছি, নব্য জেএমবির যারা ধরা পড়েছে এদের প্রায় সকলেই জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সঙ্গে জড়িত ছিল। সেখানে তারা সংগঠনের ইচ্ছাতেই গিয়েছে নাকি সম্পর্ক ছিন্ন করেছে… এক্ষেত্রে তাদের সম্পৃক্ততা এসেই যায়।”

যারা অর্থ যুগিয়েছে, তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল কিনা- এ প্রশ্নে মনিরুল বলেন, “সন্ত্রাসবাদ একটি রাজনৈতিক মতবাদ। যারা এসব করতে চায়- তাদের উদ্দেশ্য বাংলাদেশে কথিত শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠা করা। আমরা দেখেছি, একাধিক রাজনৈতিক দল শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠা করতে চায়।… অর্থাৎ এদের মূল উদ্দেশ্য এক… কৌশল কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। এই কৌশলগত পার্থক্য ভবিষ্যতে ঘুচেও যেতে পারে।”

কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম, ফাইল ছবি

অন্য মামলার অগ্রগতি

মনিরুল জানান, ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি লেখক অভিজিৎ রায় হত্যার পর র‌্যাবের সহায়তায় প্রথম দিকে আটজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। কিন্তু তদন্তে উগ্রপন্থি ব্লগার  শফিউর রহমান ফারাবী ছাড়া আর কারও সম্পৃক্ততা মেলেনি।

“তারা কেউই এ ঘটনায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়নি। আমরা ডিএনএ প্রোফাইল মিলিয়েও তাদের সম্পৃক্ততা পাইনি বা কোনো সাক্ষ্য প্রমাণেও তাদের সম্পৃক্ততা প্রমাণ করতে পারিনি।”

পরে অভিযান চালিয়ে চারজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ, যাদের মধ্যে তিনজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। তাদের কথার সঙ্গে পুলিশের পাওয়া তথ্য মিলে যায় বলে মনিরুলের ভাষ্য।  

“বলা যায়, অভিজিত রায় হত্যা মামলাটির রহস্য উদঘাটিত হয়েছে। একজন এখন রিমান্ডে রয়েছে। সেও আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে চায়।”

২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে একুশের বইমেলা চলাকালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে বের হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির কাছে ফুটপাতে কুপিয়ে হত্যা করা হয় অভিজিৎ রায়কে। ওই সময় তার সঙ্গে থাকা স্ত্রী বন্যা আহমেদও হামলার শিকার হয়ে একটি আঙুল হারান।

মনিরুল বলেন, হামলায় উসকানির ক্ষেত্রে ফারাবির ভূমিকা ছিল। সরাসরি যারা হত্যায় অংশ নিয়েছিল, তাদের নেতৃত্ব দেওয়া মুকুল রানা ওরফে শরীফ গ্রেপ্তার হওয়ার পর বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়।

“বাকি যে নামগুলো ছিল সেগুলোর অনেক নাম ছিল সাংগঠনিক নাম। সিটিটিভির ভিডিওতে তাদের চেহারাও ছিল অস্পষ্ট। আগে ঘটনাটি মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করছিল। এক মাস আগে অভিজিৎ রায় ও  জুলহাজ মান্নান হত্যার তদন্তভার কাউন্টার টেরোরিজম বিভাগে ন্যস্ত করা হয়।”

২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল রাজধানীর কলাবাগানের লেক সার্কাস রোডের বাড়িতে প্রবেশ করে সমকামী অধিকারকর্মী জুলহাস মান্নান ও তার বন্ধু থিয়েটারকর্মী মাহবুব তনয়কে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

এ মামলায় এখন পর্যন্ত শরীফুল ইসলাম কেরামত ও রাশিদুন্নবী ভূইয়া টিপু নামে দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শরীফুল আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।

“ঘটনার সঙ্গে সে সরাসরি জড়িত না থাকলেও হত্যাকারীদের অস্ত্র সরবরাহ করেছিল। এ অভিযোগেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। একজন আসামি তার কাছে আশ্রয়ও নিয়েছিল।”

মনিরুল বলেন, আগামী ২৬শে ফ্রেব্রুয়ারির আগেই অভিজিত হত্যা মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা যাবে বলে তারা আশা করছেন। তবে জুলহাজ-তনয় হত্যার রহস্য উদঘাটনে আরও সময় লাগবে।