মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সংখ্যার দিক দিয়ে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এ মামলার রায় ঘোষণার দ্বিতীয় দিনে তিন সদস্যের বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার তার পর্যবেক্ষণে কয়েক দফা সুপারিশ ও মতামত তুলে ধরেন।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসার পরের মাসেই বিডিআরে বিদ্রোহ দেখা দেয়। ঢাকার পিলখানায় বাহিনীর সদর দপ্তরে বিদ্রোহী জওয়ানদের হাতে মারা যান ৫৭ সেনা কর্মকর্তা।
রক্তাক্ত সেই বিদ্রোহে বেসামরিক ব্যক্তিসহ মোট ৭৪ জন প্রাণ হারান। ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে জওয়ানদের বিদ্রোহ।
এ মামলার ৮৫০ আসামির মধ্যে জজ আদালতে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়া ২৫৬ আসামিকে তিন থেকে ১০ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড হয়।
আর সোমবার হাই কোর্টের রায়ে ১৩৯ আসামির মৃত্যুদণ্ড, ১৮৫ জনের যাবজ্জীবন এবং ২২৮ জনকে তিন থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
জজ আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছিল পিলখানায় বিদ্রোহের ঘটনার পেছনে অর্থনৈতিক ‘মোটিভ’ ছিল। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ‘মোটিভও’ থাকতে পারে।
বিদ্রোহের তথ্য আগে জানতে না পারার ঘটনায় ‘গোয়েন্দা দুর্বলতা’ ছিল বলেও মনে করেছে জজ আদালত।
ওই রায়ে বিচারক বলেছিলেন, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রির ‘অপারেশন ডালভাত’ কর্মসূচিতে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআরকে জড়ানো ঠিক হয়নি। তাতে বাহিনীর ‘ঐতিহ্য’ নষ্ট হয়েছে।
তার মতামত ও সুপারিশগুলো হল-
১. বিডিআরের ডালভাত কর্মসূচির মত উদ্যোগ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর নেওয়া উচিৎ নয়। এ ধরনের কর্মসূচি বিজিবির সদস্যদের আত্মসম্মানকে ক্ষুণ্ন করে। বিডিআর (বিজিবি) কর্তৃপক্ষ এমন কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করবে না যা ক্রমান্বয়ে বাহিনীর সদস্যদের আত্মমর্যাদা ও আচরণের অবনতি ঘটায়।
২. যে কোনো বাহিনীতে অধস্তনদের সঙ্গে ঊর্ধ্বতনদের পেশাদারিত্বমূলক সম্পর্ক বজায় রাখা উচিৎ। বিজিবির কাঠামোতে বাহিনীর আইন অনুযায়ী সে সম্পর্ক প্রতিপালন করা প্রয়োজন। সেজন্য সময় সময় মতবিনিময় করা প্রয়োজন।
৩. পিলখানায় বিদ্রোহের আগে বিজিবি সদস্যরা বিজিবি কর্তৃপক্ষ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে কিছু দাবি এবং সমস্যা তুলে ধরেছিল। কিন্তু তারা কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। এ ধরনের আমলাতান্ত্রিকতা দূর করতে হবে।
৪. যদি কোনো প্রচ্ছন্ন ক্ষোভ থেকে থাকে, তা প্রশমন করার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
৫. বাহিনীতে কারও কোনো পাওনা যদি থেকে থাকে, তাও দ্রুত পরিশোধ করতে হবে।
৬. আদালত প্রত্যাশা করছে যে, বিজিবি কর্তৃপক্ষ বিজিবি সদস্যদের ছুটিসহ অপরাপর সকল সমস্যার সমাধান করবে।
৭. বিডিআরের নিজস্ব গোয়েন্দা বাহিনী ছিল। পিলখানায় সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল সংরক্ষিত। গোয়েন্দা বাহিনী বিদ্রোহের আগে কোনো তথ্য দিতে কেন ব্যর্থ হয়েছে? কেন তারা নিশ্চুপ ছিল? এটা কর্তৃপক্ষকে তদন্ত করে দেখতে হবে। বিজিবি কর্তৃপক্ষ এ বিষয়টি তদন্তে একটি কমিটি করবে এবং এ কমিটি তাদের প্রতিবেদন দ্রুত জনসম্মুখে প্রকাশ করবে।
এর আগে রোববার সকালে রায় শুরুর পর বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী তার হাজার পৃষ্ঠার পর্যবেক্ষণের সংক্ষিপ্তসার পড়ে শোনান।
সেখানে তিনি বলেন, “বিডিআর বিদ্রোহের মূল লক্ষ্য ছিল সেনা কর্মকর্তাদের জিম্মি করে যে কোনো মূল্যে তাদের দাবি আদায় করা। বাহিনীর চেইন অব কমান্ড ধ্বংস করে এই সুশৃঙ্খল বাহিনীকে অকার্যকর করা। সেনাবাহিনী-বিডিআরকে সাংঘর্ষিক অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির মাধ্যমে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন নবনির্বাচিত একটি গণতান্ত্রিক সরকারকে অস্থিতিশীলতায় নিপতিত করা। এমনকি জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ক্ষতিগ্রস্ত করা।”
আর সোমবার রায়ের আদেশ অংশ ঘোষণা করার আগে তিনি বলেন, কেবল একটি বিষয় ছাড়া বাকি সব পর্যবেক্ষণেও তারা একমত হয়েছেন। সেগুলো বেঞ্চের অভিমত হিসেবে গণ্য হবে।
রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী পারভীন জবার জবানবন্দি থেকে উদ্ধৃত করে সংক্ষিপ্ত পর্যবেক্ষণে বিচারপতি শওকত হোসেন বলেন, “ওই সাক্ষী বলেছেন, ‘এরা (বিদ্রোহী জওয়ান) মানুষ ছিল না। এদের আচরণ ছিল পশুর মত। তারা যে সম্মিলিতভাবে ওই ঘটনা ঘটিয়েছে, তা সাক্ষীর জবানবন্দিতেই ফুটে উঠেছে। এটা একটা দিক। ”
আবার ১৯৮১ সালে রংপুর ডাক বাংলোয় নিজের দেখা একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে এই জটিলতার আরেকটি দিক সম্পর্কে বলেন বিচারপতি শওকত হোসেন।
“সেখানে আমি দেখেছি, একজন সৈনিক একজন সেনা কর্মকর্তার জুতা পরিষ্কার করে মোজা পরিয়ে দিচ্ছেন। কর্মকর্তা ও সৈনিকদের মধ্যে সার্ভিসের এই মানসিকতা বদলানো প্রয়োজন। এই আচরণ মানবিক ও প্রশাসনবান্ধব হতে হবে।
“মনে রাখতে হবে, সৈনিকরা অন্য কোনো দেশের মানুষ না, এ দেশেররই সন্তান।… কেবল বাহিনীতে নয়, সব ক্ষেত্রেই এ ধরনের ঔপনিবেশিক মানসিকতার আচরণ বদলাতে হবে।”