মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সংখ্যার দিক দিয়ে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এ মামলার আপিল শুনানিতে গঠিত হাই কোর্টের তিন সদস্যের বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার সোমবার সকাল ১০টা ৫৪ মিনিটে তার পর্যবেক্ষণের সংক্ষিপ্তসার পড়া শুরু করেন।
বেলা পৌনে ১টায় তিনি পর্যবেক্ষণ পড়া শেষ করলে আদালত মধ্যাহ্ন বিরতিতে যায়। তার আগে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক শওকত হোসেন জানান, মূল রায় (আদেশের অংশ) ঘোষণা শুরু হবে বেলা আড়াইটায়।
এর আগে রোববার সকালে রায় শুরুর পর বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী তার হাজার পৃষ্ঠার পর্যবেক্ষণের সংক্ষিপ্তসার পড়ে শোনান।
পর্যবেক্ষণ আলাদাভাবে দিলেও আসামিদের সাজার বিষয়ে তিন বিচারক সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন বলে জানিয়েছেন বিচারপতি শওকত হোসেন।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসার পরের মাসেই বিডিআরে বিদ্রোহ দেখা দেয়। ঢাকার পিলখানায় বাহিনীর সদর দপ্তরে বিদ্রোহী জওয়ানদের হাতে মারা যান ৫৭ সেনা কর্মকর্তা। রক্তাক্ত সেই বিদ্রোহে বেসামরিক ব্যক্তিসহ মোট ৭৪ জন প্রাণ হারান। ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে জওয়ানদের বিদ্রোহ।
বিদ্রোহের মামলায় বিডিআর বাহিনীর বিশেষ আদালতে ৬ হাজার জওয়ানের কারাদণ্ডের পর পিলখানায় হত্যাকাণ্ডের মামলাটির বিচার শুরু হয় সাধারণ আদালতে।
ঢাকার জজ আদালত ২০১৩ সালে এ মামলার রায়ে ৮৫০ আসামির মধ্যে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। এছাড়া ২৫৬ আসামিকে তিন থেকে ১০ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের সাজা কার্যকরের অনুমতি (ডেথ রেফারেন্স) ও আপিল এরপর আসে হাই কোর্টে। শুনানি শেষ হওয়ার সাত মাস পর হাই কোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ রোববার রায় দেওয়া শুরু করে।
বিদ্রোহের পেছনে ‘স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র’
আলোচিত এ মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী রোববার বলেন, “বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার পূর্বাপর আলোচনা ও পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, এ ঘটনা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক-সামাজিক নিরাপত্তায় বিঘ্ন সৃষ্টির লক্ষ্যে একটি স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র। শুধু তাই নয়, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে একটি দক্ষ, প্রশিক্ষিত বাহিনীকে ধ্বংসেরও চেষ্টা।
“কিন্তু ধ্বংসের সে চক্রান্ত রুখে দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গৃহীত পদক্ষেপ অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। সদ্য নির্বাচিত ও দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকার প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অসীম ধৈর্য, বিচক্ষণতা ও সাহসিকতার সঙ্গে দৃঢ় মনোবল নিয়ে শক্ত হাতে বিদ্রোহ দমনে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।”
বিএনপি নেতাসহ সাবেক কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা তখন দাবি করেছিলেন, বিদ্রোহ সামলাতে সরকারের পদক্ষেপ যথাযথ ছিল না। ত্বরিত পদক্ষেপ নিয়ে সেনাবাহিনীকে অভিযান চালাতে দিলে অনেককে বাঁচানো যেত।
বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক শওকত হোসেন রোববার প্রারম্ভিক বক্তব্যে স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে বিভিন্ন সময়ে এই আধা সামরিক বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা তুলে ধরে বলেন, “জওয়ানরা ঔদ্ধত্বপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে সেই ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ভুলুণ্ঠিত করেছে। ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে দেশের আইনের শাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা বিনষ্টের চক্তান্তে লিপ্ত হয়।
“এমনকি দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়াসহ স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের উপর প্রত্যক্ষ হুমকির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় সৃষ্টির মাধ্যমে নিজেদের ইতিহাসকে আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করেছে। এই কলঙ্কের চিহ্ন তাদের বহুকাল বহন করতে হবে।”
জজ আদালতের রায়
বিডিআর জওয়ানদের ওই রক্তাক্ত বিদ্রোহের পর ৫৭টি বিদ্রোহের মামলার বিচার হয় বাহিনীর নিজস্ব আদালতে। আর হত্যাকাণ্ডের বিচার চলে বকশীবাজারে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত মহানগর দায়রা জজ আদালতের অস্থায়ী এজলাসে।
ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. আখতারুজ্জামান ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ওই রায়ে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেওয়া বিডিআরের উপ সহকারী পরিচালক তৌহিদুল আলমসহ বাহিনীর ১৫২ জওয়ান ও নন কমিশন্ড কর্মকর্তার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। পাশাপাশি তাদের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়।
এ মামলার সাড়ে ৮০০ আসামির মধ্যে ওই রায়ের দিন পর্যন্ত জীবিত ছিলেন ৮৪৬ জন। তাদের মধ্যে ১৬১ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
পাশাপাশি অস্ত্র লুটের দায়ে তাদের আরও ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং ২০ হাজার টাকা জারিমানা, অনাদায়ে আরও দুই বছরের কারাদণ্ড দেন বিচারক। এছাড়া ২৫৬ আসামিকে তিন থেকে ১০ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। কারও কারও সাজার আদেশ হয় একাধিক ধারায়।
অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় রায়ে ২৭৭ জনকে বেকসুর খালাস দেয় বিচারিক আদালত।
রায়ে বলা হয়, ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআর সদরদপ্তরে বিদ্রোহের ঘটনার পেছনে অর্থনৈতিক ‘মোটিভ’ ছিল। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ‘মোটিভও’ থাকতে পারে।
এই বিদ্রোহের তথ্য আগে জানতে না পারার ঘটনায় ‘গোয়েন্দা দুর্বলতা’ ছিল বলেও মনে করেছে আদালত।
সেই রায়ে বিচারক বলেন, “সামরিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ধ্বংস করার মোটিভ নিয়ে এই বিদ্রোহের ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। বহির্বিশ্বের কাছে আমাদের দেশকে ছোট করা, বিদেশি বিনিয়োগ না আসার জন্য কলকাঠি নাড়া হয়েছে।”
আদালত মনে করে, দেশের ‘অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড’ দুর্বল করার জন্য ওই বিদ্রোহ ঘটানো হয়ে থাকতে পারে। আর সশস্ত্র বাহিনীকে নিরুৎসাহিত করাও এর একটি কারণ হতে পারে।
এই বাহিনীর সদস্যদের আবারও জাতিসংঘ শান্তি মিশনে পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া এবং পিলখানার ভেতরে স্কুলে সাধারণ বিডিআর সদস্যদের সন্তানদের ভর্তির ব্যাপারে আরও ছাড় দেয়ার পরামর্শ দেন বিচারক।
“সেনাসদস্যদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ রেখে বিডিআর সদস্যরা দেশের নিরাপত্তা রক্ষার কাজে নিয়োজিত আছেন। এ জন্য প্রতিরক্ষা বাহিনীর মতো ২০ শতাংশ ভাতা তাদের পাওয়া উচিত। তাদের ঝুঁকিভাতা দেয়া যায় কি না, তাও দেখা উচিত,” পর্যবেক্ষণে বলেন তিনি।