শাপমুক্তির অপেক্ষায় শব্দকরের জীবন

এক সময় পেশা ছিল বাড়ি বাড়ি গিয়ে গান করা, পরিচয় তাই ‘শব্দকর’; সময়ের বদলে সেই পেশা হারিয়েছে; বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের ভূমিহীন এই জনগোষ্ঠীর অধিকাংশের এখন দিন চলে দিনমজুরি আর ভিক্ষা করে। 

মাসুম বিল্লাহ কমলগঞ্জ থেকে ফিরেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Nov 2017, 07:43 AM
Updated : 24 Nov 2017, 08:18 AM

মৌলভীবাজারের চারটি উপজেলা এবং সিলেট, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় শব্দকরদের বসবাস। শিক্ষার সঙ্গে কর্মসংস্থানে পিছিয়ে থাকা এই মানুষগুলোর পিছু ছাড়েনি জাতপাতের বৈষম্য।   

বাংলাপিডিয়ায় শব্দকরদের স্থান হয়েছে দলিত সম্প্রদায়ের তালিকায়। লেখা হয়েছে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে গানবাজনা করে দক্ষিণা নেওয়া এদের পেশা।

সেই গান তারা নিজেদের মধ্যে এখনও গায়, কিন্তু তাতে পয়সা মেলে না। অনেক হিন্দুর কাছে তারা ‘নিচু জাতের’ মানুষ, আর অনেক মুসলমানের কাছে ‘অচ্ছুৎ’। বঞ্চনার জীবন বদলে মূল স্রোতে আসার তেমন কোনো চেষ্টাও তাদের নেই।  

শব্দকরদের ইতিহাস নিয়ে কাজ করা গবেষক আহমদ সিরাজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মানুষ বেঁচে থাকার জন্য অনেক কিছু করে, কিন্তু শব্দকররা ব্যতিক্রম। মাঝে মাঝে মনে হয়, তারা নিস্তব্ধ-নিস্তরঙ্গ জীবনযাপন করছে; শিক্ষা আর নানা রকম সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত, সমাজের মূলস্রোত থেকেও বিচ্যুত তারা।”

মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বী হলেও এ জনগোষ্ঠির জীবনাচারে রয়েছে মিশ্র প্রভাব। শব্দকরদের মধ্যে এক দিকে যেমন শিব পূজা, চড়ক পূজার চল রয়েছে, তেমনি মুসলমানদের পীর ও দরগা সংস্কৃতির প্রতিও তাদের অনুরাগ দেখা যায়।

সিরাজ বলেন, “শব্দকররা বিশ্বাস করে, তারা সূর্যের বংশধর। মুনির অভিশাপে তারা সমাজে অচ্ছুৎ হয়ে আছে। তারা কখনও রাজশাসনের অনুকূলে আসেনি। তারা মূলত শৈব অর্থাৎ শিবের অনুসারী। মহাদেব শিবের মত করেই জীবনযাপন করে। তাদের মধ্যে ব্রাহ্মণ্যবাদের কোনো ছাপ নেই। তারা নিজেদের মত করেই ধর্মীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে।”

একক উপজেলার হিসাবে সবচেয়ে বেশি শব্দকরের বসবাস মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে; সেখানকার ২৩৭টি গ্রামের মধ্যে ৩৭টিতে সাত হাজারের মতো শব্দকর আছেন। তাদের ৭০ শতাংশই ভূমিহীন।

উপজেলার ধাতাইলগাঁও গ্রামের ষাটোর্ধ্ব লটই শব্দকর দিনমজুরি করে যা পান, তাতে সারা বছর চলে না। ক্ষেতের কাজ করে একটা সময় চলতে পারলেও অভাবে পড়লে কিস্তির ঋণ নিয়ে পেট চালাতে হয়।

ওই গ্রামের নিমাই শব্দকরের পাঁচজনের সংসার; কিন্তু নিজস্ব মাথা গোঁজার ঠাঁই পর্যন্ত নেই।এক বেলা কাজে গেলে খেতে পান, আরেক বেলা কাটে না খেয়ে।

কেবল শব্দকর হওয়ার কারণে দিনমজুরির কাজে তাচ্ছিল্যের পাশাপাশি কম টাকা পাওয়ার কথা জানান নিমাই শব্দকর।

“ধরেন, আফনার খাজে গেছি। আপনার লেখাফড়া আছে, ধনসম্পদ আছে। বলবে, এই ছু্‌ইছ না, এই ধরিছ না। এই ভাবে হিংসা করবে। কাজে যদি লাগি, অন্য লোকে যদি লাগে ৪০০ টাখা, তাহলে আমরারে ২০০ টাখা দিবে।”

কিছুটা পড়ালেখা করায় নিজেকে অন্যদের তুলনায় এগিয়ে থাকা একজন হিসেবেই দেখেন নিয়তি রাণী শব্দকর। তিনিও জানান, ১৯৮০ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর কেবল শব্দকর হওয়ার কারণেই আর এগোতে পারেননি।

“শব্দকর সমাজতো সবসময় অবহেলিত। অর্থের জোর নাই বিদ্যার জোরও নাই। এদের অনেকে ভিটেবাড়ি ছাড়া। কাজ করে ভিক্ষা করে যদি লেখাপড়া করাইল, শেষে দেখা যায় চাকরি নাই। এমনও আছে, আমাদের শব্দকর সমাজে আইএ পাস করে বিএ পাস করে আমাদের শব্দকররা ঘরে বসে খাচ্ছে।”

আগের চাইতে ‘হিংসা-নিন্দা’ কিছুটা কমে এলেও পরিস্থিতি পুরো বদলায়নি বলে জানান এই শব্দকর নারী। তার মেয়ে শ্রাবন্তী রাণী কর জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। কিন্তু শব্দকর হওয়ায় তাকে উপবৃত্তি দেওয়া হয়নি বলে নিয়তির অভিযোগ।

শব্দকর সমাজ উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক উপেন্দ্র শব্দকর জানান, আগে তার সম্প্রদায়ের অনেকের জমিজমা ছিল। কিন্তু বঞ্চনার জীবনে এখন বেশিরভাগই ভূমিহীন।

“চাকরি করে এমন সংখ্যা হতে পারে শতকরা দুই-তিন জন। বাকিরা হয় ক্ষেতে কাজ করে, অন্যের বাড়িতে কাজ করে, রিকশা চালায়; একটা অংশ ভিক্ষা করে।”

গবেষক আহমদ সিরাজ জানান, মৌলভীবাজারের ছয় উপজেলায় ১০৯টি গ্রামে শব্দকরদের পাওয়া যায়। হবিগঞ্জের তিন উপজেলায় ১৫টি গ্রামে, সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার আট গ্রামে এবং সিলেটের দুই উপজেলায় ১১ গ্রামে এই সম্প্রদায়ের দেখা মেলে। সব মিলিয়ে বৃহত্তর সিলেটে ১৪৩ গ্রামে প্রায় ২৫ হাজার শব্দকর রয়েছেন।

তার মতে, বহু যুগ আগে থেকে মূলস্রোতের বাইরে জীবনযাপন করে আসা এই জনগোষ্ঠী নিজেদের পেশা হারিয়ে ফেলার পর দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে আটকা পড়ে বৈষম্যের কবল থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারছে না। অথচ এই শব্দকরদের সিলেট অঞ্চলের লোকসংস্কৃতির বড় একটি ভাণ্ডার বলা যায়।

 

“ধামাইল গান, চড়ক ‍নৃত্যের গান, বিয়ের গান, শিবের গান, যাদুমন্ত্রের গান…  অসংখ্য গান এরা গেয়ে থাকে। বহু গীত আছে, যা মুখে মুখে চলে আসছে। বই পুস্তকে যা ধরা হয়নি, সেসব থেকে গেছে শব্দকরদের জীবনযাপনে।”

সেই সম্পদ ধরে রাখার পাশাপাশি শব্দকরদের নিজস্বতাকে বাঁচাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাদের বিশেষ উন্নয়ন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্তি এবং তাদের শিক্ষাপ্রাপ্তি সহজ করার কথা বলেন শব্দকর সমাজ উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের এই উপদেষ্টা।