ঢাকার আশুলিয়ার এই পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের পাঁচ বছর পূর্তির আগে এর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অবহেলাজনিত হত্যার অভিযোগের মামলাটির খবর নিতে গেলে এই চিত্র দেখা যায়।
শ্রমিক নেতারা মামলাটির এই হাল দেখে হতাশা প্রকাশ করে বলছেন, এটি নিষ্পত্তি হয়ে দোষিদের শাস্তি হলে পরবর্তীতে এই ধরনের অন্য ঘটনাগুলো এড়ানোর সুযোগ তৈরি হত।
সাক্ষী হাজির করতে না পারায় আদালতের ভর্ৎসনাও শুনেছেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিরা। আত্মপক্ষ সমর্থনে তারা বলছেন, মামলাটিতে অধিকাংশ সাক্ষী শ্রমিক, আগের ঠিকানায় তাদের পাওয়া যাচ্ছে না।
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর তাজরীন ফ্যাশনসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১১১ জন শ্রমিক মারা যান, দগ্ধ ও আহত হন ১০৪ জন।
তাজরীনে আহত এক শ্রমিক সবিতা রানী বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে বলেন, “তৃতীয় তলায় কাজ করছিলাম। ফায়ার অ্যালার্ম বাজার পরও কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কাজ চলছিল। আগুন লাগার পর নিচে এসে দেখি গেইটে তালা।”
বিশ্বজুড়ে আলোচনা তোলা এই অগ্নিকাণ্ডের পর সমালোচনার মুখে পুলিশ বাদী হয়ে একটি
মামলা করে। এক বছর বাদে ২০১৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন সিআইডির পরিদর্শক এ কে এম মহসীনুজ্জামান খান।
অভিযোগপত্রে আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০৪ ও ৩০৪ (ক) ধারা অনুযায়ী ‘অপরাধজনক নরহত্যা’ ও ‘অবহেলার কারণে মৃত্যু’ সংঘটনের অভিযোগ আনা হয়।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, ভবনটির নকশায় ত্রুটি ও জরুরি নির্গমনের পথ ছিল না এবং আগুন লাগার পর শ্রমিকরা বাইরে বের হতে চাইলে নিরাপত্তাকর্মীরা কলাপসিবল গেট লাগিয়ে দিয়েছিলেন।
শ্রমিকদের বের হতে না দিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার মামলাটিতে তাজরীনের মালিক দেলোয়ার হোসেন ও তার স্ত্রী মাহমুদা আক্তারও আসামি।
প্রায় তিন বছর পর ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ১৩ আসামির বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বিচার।
মামলার নথিপত্রে দেখা যায়, ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে গত ৮ নভেম্বর সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখে রাষ্ট্রপক্ষ কোনো সাক্ষী হাজির করতে পারেনি। তার আগেও কয়েকটি তারিখ পেরিয়েছে সাক্ষী না আসায়।
গত ২ এপ্রিল সাক্ষী আনতে না পারায় রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর কাজী শাহানাকে তৎকালীন বিচারক এস এম সাইফুল ইসলাম ভৎর্সনা করেছিলেন। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি।
দুই বছরে রাষ্ট্রপক্ষে মাত্র সাতজনের সাক্ষ্য নিতে পেরেছেন বিচারক। তারা হলেন- বাদী আশুলিয়া থানার এসআই খায়রুল ইসলাম, মামলার রের্কডিং কর্মকর্তা এ এসআই শাহজালাল মিয়া, আশুলিয়া এলাকার মো. সোনা মিয়া, তাজরীনের সুয়িং অপারেটর মাহে আলম (বাড়ি রংপুর), কোয়ালিটি অপারেটর রাকিব হাসান (বাড়ি নাটোরের সিংড়ায়), অপারেটর লাইলী বেগম (বাড়ি ময়মনসিংহে), আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের সবুর মন্ডল।
আদালতকর্মীরা বলছেন, তদন্ত কর্মকর্তা বেশিরভাগ সাক্ষীর স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ না করায় অস্থায়ী ঠিকানায় আদালতের পাঠানো পরোয়ানা ফেরত আসছে। বেশিরভাগ সাক্ষীই পোষাক শ্রমিক । তারা আগের ঠিকানা পরিবর্তন করেছেন বলে তাদের পাওয়া যাচ্ছে না।
অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর কাজী শাহানা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা চেষ্টা করছি সাক্ষী আনার। অনেক সাক্ষীর স্থায়ী ঠিকানা না থাকায় অসুবিধা হচ্ছে। সে কারণে মামলাটি এগুচ্ছে না।”
মামলাটি এগিয়ে নিতে রাষ্ট্রপক্ষের গাফিলতি রয়েছে বলে মনে করেন পোশাককর্মীদের পক্ষে মামলাটি দেখভালকারী শ্রমিক নেতা শহীদুল ইসলাম সবুজ।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আসামিদের পক্ষ নিয়ে বিচার প্রলম্বিত করে লোকজনের মন থেকে ওই ঘটনাকে ভুলিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে।”
মামলাটির এই অবস্থায় হতাশ বাংলাদেশ প্রগতিশীল গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শেখ মোহাম্মদ জাকির হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জনগুরুত্বসম্পন্ন এ মামলার বিচার তাড়াতাড়ি ও সুষ্ঠুভাবে নিষ্পত্তি হলে গার্মেন্টসে অবহেলার কারণে আগুন লাগার ঘটনা, অব্যবস্থাপনার কারণে শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা কমে যেত।”