‘ঘোড়ামারা’ আজিজসহ ৬ যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড

একাত্তরে গাইবান্ধা এলাকায় অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যার মত মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের দায়ে সাবেক সাংসদ জামায়াত নেতা আবু সালেহ মুহাম্মদ আব্দুল আজিজ মিয়া ওরফে ঘোড়ামারা আজিজসহ ছয় আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত।

নিজস্ব প্রতিবেদক  বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Nov 2017, 05:58 AM
Updated : 10 Jan 2018, 03:47 AM

বিচারপতি শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বুধবার এ মামলার রায় ঘোষণা করে।

রায়ে বলা হয়, প্রসিকিউশনের আনা তিন অভিযোগের সবগুলোই প্রমাণিত হয়েছে। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে আসামিদের সাজা কার্যকর করতে হবে।

আসামিদের মধ্যে আব্দুল আজিজ মিয়া (৬০), মো. রুহুল আমিন ওরফে মঞ্জু (৬৩), আবু মুসলিম মোহাম্মদ আলী (৬০),  মো. নাজমুল হুদা (৬২) ও মো. আব্দুর রহিম মিঞা (৬৪) পলাতক। রায়ের সময় কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন কেবল মো. আব্দুল লতিফ (৬৩)।

পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তার করে সাজা কার্যকর করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের আইজিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে।

তিন অভিযোগের মধ্যে প্রথমটিতে গাইবান্ধার মৌজামালি বাড়ি গ্রামে গিয়ে লুটপাট, স্বাধীনতার পক্ষের লোকজনকে আটক, অপহরণ ও নির্যাতন এবং পরে দাড়িয়াপুর ব্রিজে নিয়ে একজনকে হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে হত্যার ঘটনায় আসামিদের আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল

দ্বিতীয় অভিযোগে  সুন্দরগঞ্জ থেকে ছাত্রলীগ নেতা মো. বয়েজ উদ্দিনকে ধরে মাঠেরহাট রাজাকার ক্যাম্প এবং থানা সদরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে আটকে রেখে নির্যাতন এবং পরে গুলি করে হত্যা করে তার লাশ মাটির নিচে চাপা দেওয়ার ঘটনায় ছয় আসামির সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

তৃতীয় অভিযোগে সুন্দরগঞ্জ থানার পাঁচটি ইউনিয়নে স্বাধীনতার পক্ষের ১৩ জন চেয়ারম্যান ও মেম্বারকে আটক করে আটকে রেখে নির্যাতন এবং পরে নদীর ধারে নিয়ে গুলি করে হত্যার ঘটনাতেও আসামিদের সবার প্রাণদণ্ডের রায় এসেছে। 

রায়ের পর প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন প্রসিকিউটর সায়েদুল হক সুমন

রায়ের পর লতিফের আইনজীবী খন্দকার রেজাউল আলম সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা ন্যায়বিচার পাইনি। আপিল করব।”

পলাতক আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী গাজী এম এইচ তামিম বলেন, “প্রসিকিউশন এ মামলায় যেসব সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপন করেছে তাতে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে না। ২০০১ ও ২০০৭ সালের যেসব দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে, সেগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল।” 

পলাতক আসামিরা আত্মসমর্পণ করে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে সবাই খালাস পাবেন বলে আশা প্রকাশ করেন এই আইনজীবী।

অন্যদিকে এ মামলার প্রসিকিউটর সায়েদুল হক সুমন বলেন, “রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। ন্যায্য বিচার পেয়েছি।”

নিয়ম অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালের মামলায় রায়ের এক মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করা যায়। তবে পলাতক পাঁচ আসামিকে সে সুযোগ নিতে হলে আত্মসমর্পণ করতে হবে।

অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে গতবছর ২৮ জুন এই ছয় আসামির বিচার শুরু করে আদালত। ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত রায় আসা ২৯টি মামলার ৬২ আসামির মধ্যে তিনজন বিচারাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। মোট ৫৯ জনের সাজা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৩৬ যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ সাজার রায় এসেছে।

সাবেক সাংসদ আবু সালেহ মুহাম্মদ আব্দুল আজিজ মিয়া, (ফাইল ছবি)

ছয় যুদ্ধাপরাধী

অভিযোগপত্রে বলা হয়, জামায়াতের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আজিজ মিয়া ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত চার দলীয় জোটের অধীনে গাইবান্ধা সুন্দরগঞ্জ-১ আসনে সংসদ সদস্য ছিলেন। একাত্তরে তার হাত দিয়েই গাইবান্ধায় পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা দেওয়ার জন্য শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল।

২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে দুটি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাসহ ১৩টি মামলা হয়। ২০১৩ সালে সুন্দরগঞ্জ থানায় চার পুলিশ সদস্য হত্যা মামলায় অন্যতম আসামি এই আজিজ।

বাকিদের মধ্যে জামায়াতের সুন্দরগঞ্জ থানা শাখার সক্রিয় সদস্য রুহুল আমিন ওরফে মঞ্জুও একাত্তরে গাইবান্ধায় শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখেন এবং পরে নিজেও যুদ্ধাপারাধে অংশ নেন। পরে তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দুটি মামলা হয়।

মো. আব্দুল লতিফ ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর একজন সক্রিয় কর্মী এবং সুন্দরগঞ্জ উপজেলা পর্যায়ের নেতা। তার বিরুদ্ধে সুন্দরগঞ্জ থানায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগসহ তিনটি মামলা হয়।

আবু মুসলিম মোহাম্মদ আলী  মুক্তিযুদ্ধের আগে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের সক্রিয় নেতা ছিলেন। পরে জামায়াতে ইসলামীতে সক্রিয় হন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধে জড়ান। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে পরে তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়।

১৯৭০ সাল থেকে জামায়াতের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত নাজমুল হুদার বিরুদ্ধে দুটি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা হয়। ১৯৯৫ সালে তিনি বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হন বলে প্রসিকিউশনের তথ্য।

আব্দুর রহিম মিঞা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে জামায়াতের কর্মী ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। স্বাধীনতার পর তিনি কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন- এমন তথ্য পাওয়া যায়নি। তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দুটি মামলা হয়।

কোন অপরাধে কী সাজা

অভিযোগ

আসামি

সাজা

১. লুটপাট, অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন, হত্যা

আব্দুল আজিজ মিয়া, মো. রুহুল আমিন ওরফে মঞ্জু, আবু মুসলিম মোহাম্মদ আলী,  মো. নাজমুল হুদা ও মো. আব্দুর রহিম মিঞা পলাতক।

মো. আব্দুল লতিফ আছেন কারাগারে।

আমৃত্যু কারাদণ্ড

২. অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন, হত্যা

মৃত্যুদণ্ড

৩. আটকে রেখে নির্যাতন, হত্যা

মৃত্যুদণ্ড

বুধবার বেলা সাড়ে ১০টার আদালত বসার পর গাইবান্ধার ছয় আসামির রায়ের কার্যক্রম শুরু হয়। একমাত্র গ্রেপ্তার আসামি লতিফকে তার আগেই কারাগার থেকে আদালতে নিয়ে আসা হয়।

তিন সদস্যের এ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম প্রারম্ভিক বক্তব্যে জানান, এ মামলায় তারা যে রায় দিচ্ছেন, তা ১৬৬ পৃষ্ঠার।

পরে ট্রাইব্যুনালের বিচারক আবু আহমেদ জমাদার রায়ের সার সংক্ষেপের প্রথম অংশ পড়া শুরু করেন। বিচারপতি আমির হোসেন পড়েন রায়ের দ্বিতীয় অংশ। সবশেষে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান সাজা ঘোষণা করেন।

রায়ের পর আসামি লতিফকে আদালত থেকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। আদালতে তার পরনে ছিল কালো প্যান্ট ও সাদা শার্ট।

মামলা বৃত্তান্ত

আজিজসহ গাইবান্ধার এই ছয় জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের তদন্ত শুরু হয় ২০১৪ সালের ২৬ অক্টোবর। এক বছরের বেশি সময় তদন্তের পর ছয় খণ্ডে ৮৭৮ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা, যাতে ২৫ জনকে সাক্ষী করা হয়।

তদন্ত সংস্থা ২০১৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর ওই প্রতিবেদন চূড়ান্ত করলে প্রসিকিউশন শাখা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে। এর ওপর শুনানি নিয়ে ট্রাইব্যুনাল গতবছর ২৮ জুন আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে।

এর আগে ছয় আসামিকে গ্রেপ্তারের জন্য ২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব না হওয়ায় তাদের পলাতক দেখিয়েই এ মামলার কার্যক্রম চলে। 

বিচারিক কাজ শেষে মামলাটি গত ৯ মে রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন ট্রাইব্যুনালের তখনকার চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হক ও অপর দুই সদস্য। কিন্তু গত ১৩ জুলাই বিচারপতি হকের মৃত্যু হলে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম থমকে যায়।

এ অবস্থায় বিচারপতি শাহিনুরকে চেয়ারম্যান করে ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দী ট্রাইব্যুনাল থেকে হাই কোর্টে ফিরে যান। তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে নতুন যুক্ত হন বিচারপতি আমির হোসেন ও আবু আহমেদ জমাদার।

ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন হওয়ায় বিচারকরা রায় দেওয়ার আগে আবারও এ মামলার যুক্তিতর্ক শোনার সিদ্ধান্ত দেন গত ১২ অক্টোবর। সে অনুযায়ী ২২ অক্টোবর নতুন করে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু হয়। দুই দিন শুনানির পর মামলাটি আবারও রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়।  মঙ্গলবার জানানো হয়, রায় দেওয়া হবে বুধবার। 

প্রসিকিউশনের পক্ষে যুক্তিতর্কের শুনানি করেন সায়েদুল হক সুমন ও সৈয়দ হায়দার আলী। তাদের সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর শেখ মুশফিক কবির।

অন্যদিকে আসামিদের মধ্যে লতিফের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন খন্দকার রেজাউল এবং পলাতক আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী গাজী এমএইচ তামিম যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন।